শিমুলের স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতি নামে কানাডায় বিলাসবহুল একটি বাড়ি কেনা হয়েছে।

 

শনিবার সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনার ঝড় তুলেছে নাটোরের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল এবং তার স্ত্রীর সম্পদের পাহাড় বিষয়ক একটি খবর। দেশের বেসরকারি সম্প্রচারমাধ্যম চ্যানেল২৪’র সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ইমরান প্রতিবেদনটি করেছেন। এরপর জাতীয় দৈনিকেও এসেছে।

নিউজ হান্ট এই খবরের পেছনের খবর জানার চেষ্টা করেছে। ওই সাংবাদিক জানিয়েছেন, টানা ৪ মাসের অনুসন্ধানে তিনি খবরটি সংগ্রহ করেছেন।

তিনি তার প্রতিবেদনে বলেছেন, শিমুলের স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতীর নামে কানাডায় বিলাসবহুল একটি বাড়ি কেনা হয়েছে। গত বছরের শুরুর দিকে প্রায় দুই মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার খরচ করে ডুপ্লেক্স ওই বাড়িটি কেনেন তিনি।

ইমরান এই প্রতিবেদন করতে কানাডায় বসবাসরত সাংবাদিকদেরও সহায়তা নেন। তাদেরই একজন শওগাত আলী সাগর। সাগর জানিয়েছেন, ‘তথ্য প্রাপ্তির সুবিধার্থে কানাডার অনুসন্ধানী একটি টিমের সহায়তা নেয়া হয়েছে। উপস্থাপিত তথ্যের সমর্থনে সরকারি নথিপত্র হাতে আছে।’

টরন্টোর ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল বলছে, ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি ৫ রুম, ৫ বাথ এবং তিনটি পার্কিংসহ ওই বাড়িটির মালিকানা বদল হয়। সঞ্চিত এবং সুধীর মদন নামের দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডিয়ান ডলারে বাড়িটি কেনেন শামীমা সুলতানা জান্নাতী। ওই দিনই দুই লাখ ৭০ হাজার ডলার ট্যাক্সও পরিশোধ করেন তিনি। সব মিলিয়ে বনেদি বাড়িটি কিনতে তার খরচ হয় প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশি কোনো নাগরিক চাইলেই এভাবে বিদেশে বাড়ি কিনতে পারেন কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বিদেশে অর্থ স্থানান্তর এবং সেই অর্থে সম্পদ অর্জন দেশের মানি লন্ডারিং এবং মুদ্রা পাচার আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। আমার জানা মতে, এখন পর্যন্ত কাউকেই এই অনুমোদন দেওয়া হয়নি।’

সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল এবং তার স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতীর সব সম্পদের বিবরণসহ ঘোষণা আছে দশম এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায়। সেই হলফনামা বিশ্নেষণে দেখা যায়, ২০১৩ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য শিমুল উল্লেখ করেছেন, নগদ ১১ লাখ টাকাসহ তার এবং গৃহবধূ স্ত্রীর নামে সাকল্যে ৫১ লাখ ৩৭ হাজার টাকার সম্পদ রয়েছে। আর ২০১৮ সালের বিবরণীতে দু’জনের সম্পদের মূল্য দেখানো হয় ছয় কোটি ৫৬ লাখ টাকা। মাত্র পাঁচ বছরে সম্পদ বৃদ্ধির এই হার প্রায় তেরো গুণ!

অনুসন্ধান বলছে, স্ত্রীর নামে শিমুলের আলিশান বাড়ি কেবল কানাডাতেই সীমাবদ্ধ নয়। নাটোর সদরেও বিদেশি নকশার একটি ‘রাজপ্রাসাদ’ গড়েছেন তিনি। করোনাকালে নির্মিত ‘জান্নাতী প্যালেস’ নামের ট্রিপ্লেক্স ওই বাড়িটি নির্মাণে ঠিক কত টাকা ব্যয় হয়েছে, তার সঠিক তথ্য কেউ দিতে না পারলেও স্থানীয়দের ভাষ্য, দশ কোটি টাকার নিচে এমন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বাড়ি নির্মাণ সম্ভব নয়।

নাটোরের লোকেরা ভবনটিকে ‘এমপি বাড়ি’ হিসেবে জানলেও দলিল অনুযায়ী এই বাড়িটিরও মালিক শামীমা সুলতানা জান্নাতী। কাগজে-কলমে দেশ-বিদেশে দু-দুটি অভিজাত বাড়ির মালিক হলেও এমপিপত্নী শামীমার ব্যক্তিগত আয়-ব্যয়ের হিসাব বেশ চমকপ্রদ।

তিন বছর আগে (২০১৮-১৯) শামীমার মোট সম্পদের মূল্য ছিল দুই কোটি ১৪ লাখ টাকা। পরের বছর (২০১৯-২০) এই সম্পদ মাত্র ১৬ লাখ টাকা বৃদ্ধি পায়। তবে চলতি বছর অর্থাৎ করোনা-জর্জরিত ২০২০-২১ অর্থবছরে শামীমার সম্পদ বেড়েছে চার কোটি ২২ লাখ টাকারও বেশি, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। এর ফলে শামীমার মোট সম্পদের মূল্য এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ছয় কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ২৮৪ শতাংশ।

সরকারি খাতায় ব্যক্তিগত আয়-ব্যয়ের হিসাবে শামীমার সম্পদের এমন ঊর্ধ্বগতির সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা যেমন নেই, তেমনি মোট সম্পদের প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে কেনা কানাডার বাড়িটিরও কোনো উল্লেখ কোথাও নেই।

স্ত্রীর নামে কানাডায় বাড়ি কেনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বলেন, ‘আমার ছেলেমেয়ে কানাডায় পড়াশোনা করে। তাদের খরচের যে টাকা, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েই পাঠানো হয়। এর বাইরে কানাডায় কোনো টাকা পাঠানো হয়নি। কানাডায় আমাদের কোনো বাড়িও নেই। এসব মিথ্যা, বানোয়াট এবং আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার। আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এসব বলে বেড়ায়।’

হলফনামার অসঙ্গতি এবং নাটোরের আলিশান বাড়ি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য শিমুল ব্যস্ততা দেখিয়ে প্রতিবেদকের ফোন কেটে দেন। তার ব্যক্তিগত নাম্বারে পুনরায় কল দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।

প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর বলছেন, ‘২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দলে দলে ব্যবসায়ীরা কানাডায় এসেছেন। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করলেই তখন নাগরিকত্ব পাওয়া যেত। সে সুযোগ বন্ধ হওয়ার পর এখন নতুন ট্রেন্ড চালু হয়েছে। রাজনীতিবিদ বা আমলারা কানাডার অভিজাত এলাকায় বাড়ি কিনে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের রেখে যাচ্ছেন। সরকারি বিধিনিষেধ থাকায় নিজেরা শুরুতে থাকেন না। কিন্তু পট পরিবর্তন হলে সুযোগ বুঝে একসময় ঠিকই অভিবাসী স্ত্রীর সহযোগিতায় কানাডা উড়ে আসেন।’

জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘কানাডাসহ দেশের বাইরে যাদের সম্পদ রয়েছে, তাদের বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা আছে। তালিকা প্রস্তুতির কাজ চলছে। এ বিষয়ে কাজ করছে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুদক, বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলো। তথ্যগুলো স্পর্শকাতর বিধায় সব তথ্য প্রকাশযোগ্য নয়। কিছু আইনি জটিলতা আছে। তবে গণমাধ্যমসহ যে কারও কাছে বিদেশে অর্থ পাচার এবং সম্পদ অর্জনের তথ্য থাকলে এবং সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নজরে আনলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’