- মো: তোফাজ্জল বিন আমীন
- ২৭ মে ২০২২, ২০:০২
মানুষ যেখানে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়; সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মতো বেদনাদায়ক পথ বেছে নিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘প্রাণ’ কবিতায় লিখেছিলেন ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ অথচ পৃথিবীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরপারে যেতে কিছু শিক্ষার্থীর তাড়াহুড়োর প্রবণতা বাড়ছে। তবে আমাদের সবার জানা, আত্মহত্যা করা পাপ।
মানুষের জীবনে দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, বেদনা থাকবে এটাই জবনীচক্র। দুঃখে জর্জরিত বলে জীবন শেষ করে দিতে হবে, এটা কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাজ হতে পারে না। মানুষ তার জীবনের আমানতদার। এ আমানত রক্ষা করা প্রত্যেকের দায়িত্ব। কেউ তার দুনিয়ার জীবন ইচ্ছে করলেই শেষ করে দিতে পারে না। এর মালিক সে নয়। যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই মালিক। এটা জানার পরও কিছু শিক্ষার্থী জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যার খবর চোখে পড়ে। অথচ এমনটি আমরা কেউ প্রত্যাশা করি না। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্র কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে। একজন শিক্ষার্থী পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ। ওই সম্পদ যখন চোখের সামনে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় তখন হাজারো অভিভাবকের স্বপ্নের মৃত্যু হয়। দুঃখজন হলো- দিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১ সালে ৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে কেন এত আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে? এর কিছু কারণ উপস্থাপন করা হলো। যেমন : যৌতুক, পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, হতাশা, বেকারত্ব, প্ররোচনা, মানসিক চাপ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া, বাবা-মায়ের ওপর অভিমান, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, অবিশ্বাস, পরকীয়া, ডিভোর্স বা বিপত্নীক/বিধবা, দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, ঋণের বোঝা, মানসিক রোগে আক্রান্ত, মানসিক চাপ ও যৌন নির্যাতন।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থান বাড়ছে না। তরুণরা হতাশাগ্রস্ত ও মাদকাসক্তিতে ভোগছেন। অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে লাশ হচ্ছেন। দেশ যখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে তখন অনেকে বেকারত্বের জ্বালা নিয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছেন। কোনো দিশা পাচ্ছেন না। দিন বদলের ¯েøাগান দিয়ে বাজিমাত করা অন্যায় কিছু না। কিন্তু মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা প্রয়োজন। কী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, কী স্কুল-কলেজ সবখানে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সম্পর্কের অবনতির কারণে ২৪.৭৫ শতাংশ, পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯.৮০ শতাংশ, মানসিক যন্ত্রণায় ১৫.৮৪ শতাংশ, পড়াশোনার যন্ত্রণায় ১০.৮৯ শতাংশ, আর্থিক সমস্যায় ৪.৯৫ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করছে। ২০২১ সালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৬১ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১২ শতাংশ মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে, ৪ শতাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে, ২৩ শতাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুসারে ২০১১ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ৬৯৭ জন। প্রতি বছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এ ছাড়াও ঘুমের ওষুধ খেয়ে, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে, রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রিভেন্টিং সুইসাইড : অ্যা সোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস ২০১৭ জরিপের ভাষ্যমতে ‘প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। আর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমান বিশে^ ১৫-৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মহত্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার চাষাবাদ হয়। বাবা-মায়েরা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান ভালো মানুষ হওয়ার জন্য। কিন্তু ভালো মানুষ হওয়া দূরের কথা উল্টো নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছেন। অথচ একবারও বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করেন না। ইচ্ছে হলো আর নিজের জীবনাবসান ঘটালেন।
পৃথিবীর কোনো ধর্ম-বিশ্বাসই মানুষকে বিপথে ঠেলে দেয় না। অথচ ধর্মীয় শিক্ষার জুজুর ভয়ে পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা সঙ্কুচিত করা হয়েছে। অপকৌশলে মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়ার পথ বন্ধের পাঁয়তারা চলছে। কিন্তু এটা এখন প্রমাণিত যে, ধর্মীয় শিক্ষায় মানুষের নৈতিকতা বাড়ে। নৈতিকতা এমনি এমনি আসে না। নৈতিকতা পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো দল বা গোষ্ঠীর একক প্রতিষ্ঠান নয়। অথচ দলীয় ক্যাডার দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিপন্ন করা হচ্ছে। র্যাগিংয়ের নামে প্রচলিত আছে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। ফলে নির্যাতনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কিছু শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে ছেলে-মেয়েদের শেখানো উচিত, ভালো মন্দ যাই ঘটুক না কেন সেটা জীবনের অংশ। জীবনে বড় হওয়ার চেয়ে জীবনে ভালো মানুষ হওয়ার অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন। ভালো রেজাল্ট না করতে পারলেও আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে ধৈর্যশীল হওয়া প্রয়োজন। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো কাউন্সেলিং সেন্টার। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকলেও সেগুলো নিষ্ক্রিয়। আশা করি আত্মহত্যা প্রতিরোধে শিক্ষকমণ্ডলী, শিক্ষাবিদ, সমাজগবেষক, নীতি-নির্ধারকরা একটি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবেন।