লোহিত সাগরে অস্থিরতা : বিঘ্নিত হতে পারে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি

স্পট মার্কেট থেকে চলতি বছর ২৪ কার্গো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অবশ্য দাম কমে গেলে এটি আরো বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। গত বছর স্পট মার্কেট থেকে ২২ কার্গো এলএনজি কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। মূলত স্পট মার্কেটে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই বেশি এলএনজি কেনে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। এ অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোয় স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানি বিঘ্ন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে থাকে। এর পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করা হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য বলছে, চলতি বছরে কাতারের রাস লাফান লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড এবং ওমানের ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেডের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় মোট ৫৬ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে কাতারের প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ৪০ কার্গো এবং ওমানের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৬ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। গত বছর কাতার থেকে ৪১ কার্গো এবং ওমান থেকে ১৬ কার্গো এলএনজি আমদানি করেছে সরকার। কাতারের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১৫ বছর এবং ওমানের প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদে এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের।

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমানের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে পরিমাণ আমদানি করা হয়, তাতে দেশের এলএনজির চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। এ কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে বাড়তি চাহিদা মেটানো হয়ে থাকে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশ প্রথম এলএনজি আমদানি শুরু করে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ মার্কেট থেকে ৫২ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে স্পট মার্কেট থেকে ২২ কার্গো এলএনজি আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সুইজারল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২০২৩ সালের জন্য দুই কার্গো এলএনজি আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। আর গত ডিসেম্বরে ক্রয় কমিটির সভায় ২০২৪ সালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এক কার্গো এলএনজি আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির জন্য সরকার এ পর্যন্ত ২২টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মাস্টার সেল পারচেজ এগ্রিমেন্ট (এমএসপিএ) স্বাক্ষর করেছে। স্পট মার্কেটে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই বেশি এলএনজি আমদানি করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি এলপির কাছ থেকে চার কার্গো, সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়া পিটিই লিমিটেডের কাছ থেকে চার কার্গো ও গানভর সিঙ্গাপুর পিটিই লিমিটেডের কাছ থেকে তিন কার্গো, সুইজারল্যান্ডের টোটাল এনার্জিস গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেডের কাছ থেকে চার কার্গো এবং জাপানস এনার্জি ফর এ নিউ এরা (জেরা) কোম্পানি ইনকরপোরেশনের কাছ থেকে এক কার্গো এলএনজি কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

বৈশ্বিক নৌচলাচলের ১২ শতাংশই হয়ে থাকে লোহিত সাগর হয়ে সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে। এশিয়া থেকে ইউরোপে জাহাজে পণ্য পরিবহনে এটি সবচেয়ে দ্রুততম ও সাশ্রয়ী রুট। তবে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে গত বছরের ১৯ নভেম্বর থেকে লোহিত সাগর ও সংলগ্ন এলাকায় চলাচলরত জাহাজগুলোয় হামলা শুরু করে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। ইরান সমর্থিত ইয়েমেনি গোষ্ঠীটির দাবি, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত ও ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়া দেশের জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে। ইসরায়েল গাজায় হামলা বন্ধ করলেই কেবল তারা হামলা বন্ধ করবে বলেও জানিয়েছে হুথিরা। এরই মধ্যে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের জাহাজে তারা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তাদের এ পদক্ষেপে বিশ্বের বহু শিপিং কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা হুথিদের এসব হামলার জবাবে ইয়েমেনে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। সর্বশেষ গতকালও গ্রিসের মালিকানাধীন একটি জাহাজে হামলা চালানো হয়েছে। হামলা-পাল্টা হামলায় ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে লোহিত সাগর অঞ্চল। এরই মধ্যে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ কোম্পানিগুলো এ অঞ্চল এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। যেখানে কাতারের এলএনজি ট্যাংকারও রয়েছে। রয়টার্স সম্প্রতি জানিয়েছে, লোহিত সাগর হয়ে সুয়েজ খাল অভিমুখে যাত্রা করা কাতারের তিনটি এলএনজি ট্যাংকার তাদের যাত্রাপথ ঘুরিয়ে দিয়েছে। লোহিত সাগরের পরিবর্তে জাহাজগুলো উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে আফ্রিকা হয়ে ইউরোপে  পৌঁছাবে। এতে সময় ও অর্থ দুটোই বেশি লাগবে।

সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সভায় কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে এলএনজি পরিবহন বিঘ্নিত হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এর বিকল্প নৌপথ থাকলেও সেগুলো বর্তমান রুটের চেয়ে ব্যয় সাশ্রয়ী নয়। এ সমস্যা শুধু এ অঞ্চলকেই প্রভাবিত করছে না, এটি পুরো বৈশ্বিক বাণিজ্যকেই প্রভাবিত করছে।’

কাতার ও ওমান থেকে বাংলাদেশে এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে লোহিত সাগর পাড়ি দিতে হয় না। ফলে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে যেসব এলএনজি কার্গো আসে সেগুলোর ক্ষেত্রে আপাতত কোনো প্রভাব পড়ার শঙ্কা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ড থেকে স্পট মার্কেটে যে এলএনজি আমদানি করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে লোহিত সাগরের অস্থিরতার প্রভাব বাংলাদেশের এলএনজির সরবরাহের ওপর পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এক্ষেত্রে জাহাজগুলোকে লোহিত সাগর পেরিয়েই বাংলাদেশে আসতে হবে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ এলএনজি কার্গো আসে কাতার ও ওমান থেকে। সেক্ষেত্রে লোহিত সাগরের সাম্প্রতিক অস্থিরতার বিষয়টি কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে স্পট মার্কেট থেকে যেসব এলএনজি আমদানি করা হয়ে থাকে সেগুলোর ক্ষেত্রে প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কোন জায়গা থেকে কার্গো দেবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। সেটি যদি লোহিত সাগর হয়ে আসে তাহলে সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব কার্গো আসে তারা সাধারণত লোহিত সাগর পার হয়ে আসে।’

এনার্জি মনিটরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে সক্রিয় এলএনজি ট্যাংকারের সংখ্যা ৬৩৫টি। লোহিত সাগরের পরিবর্তে উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে ঘুরে যাওয়ার কারণে এলএনজি ট্যাংকারগুলোকে বেশি সময় সমুদ্রে থাকতে হবে। এতে করে ট্যাংকারগুলোর পরবর্তী এলএনজি পরিবহন শিডিউলও স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে যাবে। বাংলাদেশে সাধারণত একই ট্যাংকারগুলো এলএনজি পরিবহন করে থাকে। তবে কোন ট্যাংকার কোন অঞ্চলে পাঠানো হবে সেটি একান্তই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিষয়। ফলে লোহিত সাগর সংকটের কারণে এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ট্যাংকার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়তে পারে। এতে করে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশের এলএনজি সরবরাহের ওপরও।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রুটে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ চলাচল করে থাকে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ মালিকরা সরকারের কাছে লোহিত সাগর সংকটের বিষয়ে দিক নির্দেশনা চেয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিওজিএসওএ) সেক্রেটারি জেনারেল রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এএসএম আব্দুল বাতেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মালিকানাধীন জাহাজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলাচল করছে। এ ক্ষেত্রে যেসব রুট নিরাপদ, জাহাজ মালিকরা সেটিই বেছে নেবেন। তবে যথাযথভাবে বীমা করা হয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এরই মধ্যে সরকারের কাছে মৌখিকভাবে লোহিত সাগর সংকটের বিষয়ে দিক নির্দেশনা চেয়েছি। মূলত বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজগুলো এ অঞ্চল দিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে করণীয় কী সেটি আমরা জানতে চেয়েছি।’

সার্বিক বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লোহিত সাগর সংকটের কারণে এলএনজিবাহী জাহাজ সরবরাহ বন্ধ নিয়ে কোনো ধরনের প্রভাব নেই। সরবরাহকারীরা নিয়মিত কার্গো সরবরাহ করছে। পরিস্থিতির বিষয়ে আমরা অবহিত আছি। সে ধরনের কোনো সংকট এলএনজি আমদানিতে রয়েছে বলে মনে করি না।’

বনিক বার্তা