বাংলাদেশে সত্যিকার অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার কায়েম হোক, এটি দেখার জন্য ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. পিটার হাস তার আগ্রহ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিদ্যমান সরকার যে নির্বাচিত নয় সে বিষয়ে মার্কিন সরকারের রয়েছে পরিষ্কার ধারণা। এ কারণে কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সমাবেশে বাংলাদেশ মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণ পায়নি। তা ছাড়া গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বাংলাদেশের কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
মিস্টার হাস অবাধ নির্বাচনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অন্য এক উপলক্ষে বলেছিলেন, নির্বাচনে কারা বিজয়ী হবে তা নিয়ে আমেরিকার মাথাব্যথা নেই। তিনি যদি বিষয়টির জটিলতা বুঝতে আরো গভীরে যেতেন তাহলে তিনি বুঝতে পারতেন, যেখানে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে সংঘটিত দুর্নীতি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলে আসছে সেখানে একমাত্র অবাধ নির্বাচন দ্বারা গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।
এই ব্যবস্থার খুঁটি প্রোথিত রয়েছে দুর্নীতির মধ্যে এবং মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করে অব্যাহতি পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। রাজনীতি যে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার ব্যবসা নয়, এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। রাজনীতি করবে সত্যিকার রাজনীতিবিদরা, যারা জনকল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে নিবেদিত হবে। সুতরাং অবাধ নির্বাচনের সপক্ষে আমেরিকার সমর্থন জোগানোর অর্থ নিশ্চয়ই একদল অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের ক্ষমতাচ্যুত করে আরেকদল অনুরূপ লোকদের ক্ষমতায় বসানো হতে পারে না। আমার বিশ্বাস, অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সরকার সে ক্ষেত্রে নির্বাচন মোকাবেলা করতে যাবে না। তার আগেই সমাধান খুঁজবে। নির্বাচন ডাকাতির সুযোগ নিয়ে জনগণকে সরকার গঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না এবং তা মানা হবে না। জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিতে হবে এবং সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, যাতে নির্বাচনী কারচুপি করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করতে না পারে, ঠিক যেমনটি অন্যান্য পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় রয়েছে।
দশকের পর দশক ধরে সর্বস্তরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে লাভবান হওয়ার অপরিসীম সুযোগ থাকায় এবং ব্যাপক দুর্নীতির বিস্তার ঘটার কারণে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে একটা বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতিতে নীতিনৈতিকতা না থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ সেজে রাজনীতিকে টাকা কামানোর ব্যবসায় পরিণত করেছেন। এখনো এক বছরেরও বেশি সময় অবাধ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে; কিন্তু দেশকে অনিবার্য হিংসা-হানাহানি থেকে বাঁচানোর জন্য যে ধরনের পরিবর্তন অপরিহার্য, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। জনগণের মধ্যে দৃশ্যমান অস্থিরতা সরকারের জন্য বিপদ বলে উপেক্ষা করা যেতে পারে না। সরকারকে ঘিরে রেখেছে একদল স্বার্থান্বেষী সুবিধাভোগীর দল। তাই সরকারের কাছে নির্বাচনে কারচুপি করার বিষয়টি হবে জীবন-মরণ ইস্যু। সরকার সমর্থকদের মধ্যে হিংসাত্মক সঙ্ঘাত নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার নিজেও ব্যর্থতার ভারে অকর্মণ্য হয়ে পড়েছে।
তাই সরকারের জন্য ভালো পরামর্শ হবে, অবাধ নির্বাচনের কৌশল অবলম্বন করা এবং একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ গ্রহণ করা। প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে অবাধ নির্বাচন সম্ভব করতে চাইলে এখন থেকেই ক্ষেত্র তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে, অর্থবহ নির্বাচন না করে ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে বর্তমান সরকার বাইরের সাহায্য লাভের নিশ্চয়তা পেয়েছে, এ কথা সত্য। এখন জনগণকে তাদের নিজেদের সার্বভৌম অধিকার রক্ষার জন্য আমাদের প্রয়োজন আমেরিকার প্রকাশ্য ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সহযোগিতা। স্বৈরতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যকার প্রতিযোগিতায় শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থার স্বার্থে জনগণতন্ত্রের বিজয় অনিবার্য। একনায়কতন্ত্রের অধীনে দাসত্ব মানবিক বিষয়ে বিজয়ী হতে পারে না।
বর্তমানে কমিউনিস্ট ধরনের একনায়কত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার যে ষড়যন্ত্র চলছে বিভিন্ন দেশে, তার জায়গায় বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে বিজয়ী দেখার যে দৃঢ় সংকল্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকার দেখাচ্ছে সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। বাংলাদেশে যখন সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তখন গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে সঠিকভাবে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে শক্তিশালী সমর্থন অবশ্যই জোগাতে হবে।
বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল, গণতান্ত্রিক ভারত বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কার্যকারিতা দেখতে চাইবে; কিন্তু সেই প্রত্যাশা ভয়ঙ্করভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রস্তুতি নিতে বিলম্ব হলে তা হবে নিজেদের জন্য পুনরায় পরাজয় ডেকে আনা। সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের দেখা মিলবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনের ওপর ভরসা করা বিরাট ধাপ্পাবাজির সহজ শিকার হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অনুপস্থিতির অর্থ এটা হতে পারে না যে, সাংবাদিকদের হতে হবে অগণতান্ত্রিক পার্টির দলীয় কর্মী। বিচার বিভাগ সর্বদা সরকারের সজাগ দৃষ্টি সম্পর্কে সচেতন। দেশে কোনো গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব নেই, যা কিছু আছে তা হচ্ছে, সাজানো নির্বাচনের নীরব অংশীদার, সবাই আশা করছেন টাকা আর সিট ভাগাভাগি। নির্বাচন সামনে রেখে যে অর্থ ছাড় করানো হয় তার পরিমাণ আন্দাজ করা কঠিন।
গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের অগ্রগতি দৃশ্যমান হওয়ার আগেই দুর্নীতির সংহত এবং সম্মিলিত ব্যবস্থার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নগ্নরূপে আত্মপ্রকাশ করতে দেখা যাবে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, আমেরিকা দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রগতি উপেক্ষা করে এসেছে। যেসব দেশ মানবাধিকার বিষয়ে নির্বিকার সেই দেশগুলোকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বেশ খোশ মেজাজে আছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমেরিকা আমাদের রাজনীতির ব্যাপারে সহযোগিতাপূর্ণ আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। আমাদের জনগণও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতন্ত্র পেতে সাহায্য করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখে সানন্দে সামনের দিকে তাকাচ্ছে।
স্বাধীনতাপূর্ব পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের রাজনীতিতে গুপ্ত হত্যা, গুম এবং ফৌজদারি মামলার মাধ্যমে হয়রানির রাজনীতি ছিল না। আমাদের জনগণ দীর্ঘকাল গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে এবং রক্ত দিয়েছে; কিন্তু নেতারা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। যে কথা বুঝাতে আমরা এত উদ্বিগ্ন তা হলো- আমাদের প্রয়োজন কেবল অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়, আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে চাই। গণতান্ত্রিক দুনিয়ার নেতা হিসেবে একমাত্র আমেরিকার কাছ থেকেই তেমন পরিবর্তন প্রত্যাশা করা যায়। একশ্রেণীর শিক্ষিত, লোভী, বেঈমান লোকেরা জাতির জন্য মহাসঙ্কট সৃষ্টি করে চলেছে। তাই ব্যক্তির ওপর নয়, সিস্টেমে আমাদের নির্ভর করতে হবে; গণতন্ত্রই সেই বিশ্বাসযোগ্য সিস্টেম।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট