২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। দিনটি ছিল শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ হলেও অল্প কয়েকজন কিছু সময়ের জন্য আসেন। এ রকমই একজন জুবায়ের বিন হুদা। এসে দেখলেন প্রিন্টার কাজ করছে না। কারিগরি সমস্যা মনে করে চলে গেলেন। অন্যরা এলেন পরদিন শনিবার।
বিকল্প পথে প্রিন্টার চালু করা হলো। তখনই পাওয়া গেল প্রায় এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার হস্তান্তরের অনুরোধ জানানো সব চিঠি। ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক।
ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে বানানো প্রামাণ্যচিত্র বিলিয়ন ডলার হাইস্ট। আর এর মাধ্যমে সাত বছর পরে আবারও আলোচনায় এল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস, লন্ডনভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ান-এর মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যম এই প্রামাণ্যচিত্রের পর্যালোচনাও ছেপেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। ৮১ মিলিয়ন বা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সে সময় চুরি হয়।
রিজার্ভ চুরি থেকে তথ্য ফাঁস: ডিজিটাল নিরাপত্তা কেন এতটা দুর্বল?
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। ৮১ মিলিয়ন বা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সে সময় চুরি হয়। এসব বাংলাদেশের নাগরিকদের উপার্জিত অর্থ, যার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রামাণ্যচিত্রটিতে বিশ্বখ্যাত একদল বিশেষজ্ঞদের হাজির করেছেন পরিচালক ডেনিয়েল গর্ডন। পুরো প্রামাণ্যচিত্রটিতে ঘটনার বর্ণনায় ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক মিশা গ্লেনি। সাইবার ও সংঘটিত অপরাধ বিষয়ে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ।
এ নিয়ে তাঁর লেখা বইও রয়েছে। প্রামাণ্যচিত্রে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতামত দিয়েছেন, সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা গবেষক হিসেবে এরিক চেইন, নিউজউইকে কাজ করা মার্কিন সাংবাদিক জসুয়া হ্যামার, রয়টার্সের সাংবাদিক কৃষ্ণা দাশ এবং নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক নিকোল পার্লরথ, তিনি সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে কাজ করেন।
এ ছাড়া মতামত দিয়েছেন রাফাল রহোজিনস্কি, তিনি পোল্যান্ডের নাগরিক, ডিজিটাল ঝুঁকিবিষয়ক একজন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। আরও আছেন ফিনল্যান্ডের নাগরিক মিকো হাইপোনেন, একজন বিখ্যাত সাইবার গবেষক, সাইবার পরামর্শক এজ হিলবার্ট এবং সাবেক এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট কেইথ মুলারাস্কি।
প্রামাণ্যচিত্রটিতে চুরির ঘটনার বর্ণনা ছাড়াও কারা এর পেছনে জড়িত, কেন বাংলাদেশ ব্যাংককেই চুরির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল, কাজটা সহজে কী করে সম্পন্ন হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা—সবকিছুর ওপরেই আলো ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি সাইবার আক্রমণের ইতিহাস, ভবিষ্যতের হুমকি এবং এ ঘটনা থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যায়, এ নিয়েই বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। আর এ জন্য ব্যবহার করা হয়েছে পুরোনো নানা ফুটেজ, ঘটনার বর্ণনায় ব্যবহার করা হয়েছে নানা ধরনে অ্যানিমেশন।
সাইবার আক্রমণের ইতিহাস
শুরুর দিকেই মিশা গ্লেনি বলেন, তিনি যখন ছোট তখন থেকেই শুনে আসছিলেন ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় ডাকাতি ‘দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি’-এর গল্প। তখন ডাকাতি করা হয়েছিল আড়াই মিলিয়ন পাউন্ড (৪ মিলিয়ন বা ৪০ লাখ ডলার)। এই গল্প চলেছে ৩০ বছর। আর এখন তিনি কথা বলছেন ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টার এক গল্প। আর থেকেই ধারণা পাওয়া যাবে সাইবার অপরাধ কতটা বিপজ্জনক।
তখন জনপ্রিয় হলো অনলাইন ব্যাংকিং, মানুষ অনেক বেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে লাগল, শুরু হলো স্বয়ংক্রিয় তহবিল স্থানান্তর পদ্ধতি। তখন হ্যাকাররাও বুঝতে পারল ব্যক্তির পেছনে না দৌড়ে প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করলেই আর্থিক লাভ অনেক বেশি।
এরপর সাইবার আক্রমণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের বর্ণনা আছে। মিশা গ্লেনি এরপর বললেন, বিশ্ব ও মানবজাতির জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি চারটি মহামারি, গণবিধ্বংসী অস্ত্র, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সাইবার হামলা। অথচ ’৯০-এর দশকের শুরুতে হ্যাকাররা ছিল অল্পবয়সী, টিনএজার। তখন তারা মজা করতেই ক্ষতিকর বা ম্যালিশিয়াস সফটওয়্যার বা ম্যালওয়্যার তৈরি করত। তখন এই ভাইরাস ফ্লপি ডিস্ক থেকেই ছড়াত। এরপর এল ইন্টারনেট। আর তাতেই এসব ম্যালওয়্যার এখন সেকেন্ডের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অদক্ষতা ও অবহেলায় অর্থ চুরি
যারা খেলা হিসেবে ধরে নিয়েছিল, তারাই একসময় বুঝতে পারল, এটা অর্থ উপায়েরও একটা নতুন পথ। ২০০০ সালের আগে ভাইরাসের কাজ ছিল মূলত ওয়েবসাইট নষ্ট করা। ২০০০ সালের পর থেকে ডট কম যুগ শুরু হলে উদ্ভব ঘটে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা সাইট জিম্মি অর্থ আদায়কারী হ্যাকারদের। একটা অপরাধজগতের রাজত্ব করত সংঘবদ্ধ অপরাধী বা গ্যাংস্টাররা। নানা ধরনের অপরাধীরা এতে যুক্ত হতো। কিন্তু ’৯০-এর পর জন্ম নেওয়া একদল মানুষ, যারা অঙ্ক বা পদার্থবিদ্যায় খুব ভালো, কম্পিউটারবিজ্ঞানী, তারা সাবেক সেই গ্যাংস্টারদের যুক্তি ও নৈতিকতা গ্রহণ করল।
তারা নিজেদের তৈরি করল নতুন এক গ্যাংস্টার হিসেবে, যারা কাজ করে অনলাইনে। ভাইরাস ও ম্যালওয়্যার ছড়িয়ে অর্থ আয় করতে শুরু করল। আর তাতেই বদলে গেছে পুরো দৃশ্যপট। কেননা তখন জনপ্রিয় হলো অনলাইন ব্যাংকিং, মানুষ অনেক বেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে লাগল, শুরু হলো স্বয়ংক্রিয় তহবিল স্থানান্তর পদ্ধতি। তখন হ্যাকাররাও বুঝতে পারল ব্যক্তির পেছনে না দৌড়ে প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করলেই আর্থিক লাভ অনেক বেশি।
বাস্তব পৃথিবীতে আগে সরাসরি ব্যাংক লুট হতো। এখন হয় অনলাইন দুনিয়ায়। এখন ১০০ মিলিয়ন ডলার ডাকাতি করলে তা নিয়ে যেতেই ১০টি ট্রাক লাগবে। কিন্তু অনলাইনে ডাকাতি করলে কেউ হয়তো দেখতেই পাবে না।
কেন বাংলাদেশকে বেছে নেওয়া হয়েছিল
আমরা বাংলাদেশকে যতই সুইজারল্যান্ড, প্যারিস বা সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করি না কেন, বিশ্বে এখনো বাংলাদেশের পরিচয় অন্যতম একটি গরিব দেশ হিসেবে। যেমন, প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের পরিচয় হচ্ছে পৃথিবীর ১৭০তম গরিব দেশ। আর এমন এক দরিদ্র দেশের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার অনেক বেশি অর্থ।
কেন বাংলাদেশকে চুরির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল, এ নিয়ে বেশ মতামত দিয়েছেন মিশা গ্লেনিসহ অন্যরা। তাঁরা বলেছেন, হ্যাক করার ক্ষেত্রে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক (নিউইয়র্ক ফেড) হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো।
রিজার্ভ চুরি: চাকরি চেয়ে ই-মেইল করেছিল হ্যাকাররা
হ্যাকাররা জানে, এখানে তারা ঢুকতে পারবে না। তখন তারা দেখল ফেড বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে নিয়মিত লেনদেন করে। এ জন্য সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সংযোগ আছে। সুতরাং তারা মনোযোগ দিল এ সংযোগব্যবস্থার দিকে। ফেড অর্থ স্থানান্তরের জন্য পুরোপুরি নির্ভর করে সুইফটের (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) ওপরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থের পরিমাণ বেশি, কিন্তু নিরাপত্তাব্যবস্থা খারাপ। সাইবার হামলার জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতি এখানে আছে।