রিজভীকে ধন্যবাদ: বিলম্বে হলেও সঠিক পথে রাজনীতি

মাহমুদুর রহমান

ইংরেজী ভাষায় এক বহুল প্রচলিত বাগধারা আছে, “Better late than never”। সহজ বাংলায় যার অর্থ, কখনও না হওয়ার চেয়ে দেরিতেই হোক। গতকাল বিএনপির মুখপাত্র এবং জনপ্রিয় নেতা রুহুল কবির রিজভী তার গায়ের ভারতীয় চাদর জনসমক্ষে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাংলাদেশে ক্রমেই বেগবান হয়ে ওঠা “ভারত হঠাও” আন্দোলনের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করেছেন। এই প্রতীকী অবস্থানের মধ্য দিয়ে ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতিতে যে আদর্শগত বিচ্যুতি আমরা লক্ষ্য করছিলাম তার অবসান ঘটেছে বলে আশা করতে চাই। আমার পক্ষ থেকে রিজভীকে ধন্যবাদ।

আগের কয়েকটি লেখায় উল্লেখ করেছি যে, ২০১৬ সালের একেবারে শেষে কারামুক্ত হয়ে ভারতীয় আগ্রাসন প্রসঙ্গে বিএনপির নীতিগত পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করেছিলাম। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রে ভারতের আগ্রাসী হস্তক্ষেপের ইতিহাস সম্পর্কে লেখালেখিতে আমি বরাবরই দেশবাসীকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি। জেল থেকে বের হয়ে দেখলাম বিএনপির ভারতনীতি আমার চিন্তাধারার বিপরীত মেরুতে চলে গেছে। ভারতপন্থীরা কেবল যে দলটির নীতিনির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রাখছে তাই নয়, এমনকি জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যেও তথাকথিত সেক্যুলার ও ভারতের প্রতি অনুগতরা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে। হাসিনার নির্দেশে কুষ্টিয়ার আদালতে জঙ্গী আওয়ামী ক্যাডারদের আক্রমণের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের আগস্টে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া পর্যন্ত আমাকে একদিকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং অন্যদিকে বিএনপির ভারতপন্থীদের আক্রমন সামলাতে হয়েছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদের আদর্শ থেকে জন্ম নেয়া বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙ্গালী মুসলমানের স্বতন্ত্র পরিচয়, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের প্রতি আমি অনমনীয়ভাবে অনুগত থাকায় উভয় দলের ভারতপন্থী গ্রুপ আমাকে জামাতে ইসলামের ব্র্যাকেটবন্দি করবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কেউ জামাতে ইসলাম এবং শিবিরের তকমা পেলে তার আর বাঁচারই অধিকার থাকে না। ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে সকল ইসলামপন্থীদের এভাবেই Dehumanize করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সেই ২০১৩ সালে ভারতের শাহবাগী অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আমার দেশ নিয়ে লড়াই করার সময়েই সাংগঠনিকভাবে বিএনপির অভ্যন্তরীন আদর্শিক বিচ্যুতি দেখতে পেয়েছিলাম। সেই সময় একমাত্র বেগম খালেদা জিয়া তার আদর্শে অবিচল ছিলেন।

২০২৪ সালে বাংলাদেশের জনগণের প্রধান শত্রু কট্টর মুসলমান বিরোধী, হিন্দুত্ববাদী ভারত নামক প্রবল শক্তিমান প্রতিবেশি। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশকে কোনদিনই ভারত সরাসরি তার রাজ্য বানাবে না। কারণ দেশটির অতিরিক্ত ষোল-সতেরো কোটি মুসলমান নাগরিক দিল্লীর নিরাপত্তার জন্য মোটেও অনুকূল হবে না। কাজেই বাংলাদেশের ভাগ্য সিকিমের মত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। বাংলাদেশে একটি দুর্বল রাষ্ট্রকাঠামো বজায় রেখে ভারতের এমন একটা বিশ্বস্ত, অত্যাচারী, পুতুল সরকার প্রয়োজন যে কিনা নব্বই শতাংশ মুসলমানদের রাষ্ট্রশক্তি দিয়ে কেবল নিয়ন্ত্রণই করবে না, সেই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদ দিয়ে ক্রমশ: সমগ্র জাতির মগজ ধোলাই করবে। মগজ ধোলাইয়ের জন্য দীর্ঘ সময় লাগে। আমার ধারনা সেই মগজ ধোলাইয়ের তিরিশ-চল্লিশ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। সে কারণেই জনগণকে সতর্ক করছি যে, ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে অন্তত: ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় রাখতে সর্বরকম কূটচাল চালিয়ে যাবে। ভারত হঠাও আন্দোলন সেই কূটচালের বিরুদ্ধে সর্বাত্বক সংগ্রামের প্রথম পর্যায় মাত্র। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিল। আজ প্রায় তিন দশক পর আমরা সংক্ষেপে পর্যালোচনা করে দেখবার চেষ্টা করি যে, রাজনীতি ও সমাজ জীবনে কতটা পরিবর্তন হয়েছে। সেই পর্যালোচনা থেকে আমরা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারব যে বাংলাদেশি মুসলমানদের মগজ ধোলাই পুরোপুরি সম্পন্ন করতে ভারতের আরও কতটা সময়ের প্রয়োজন হবে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টারে হিজাব মাথায় দিয়ে নামাজরত অবস্থায় শেখ হাসিনার ছবি সারা দেশে ছয়লাপ করে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, শেখ মুজিবের কন্যা ইসলাম ধর্ম পালন করেন। তিনি ভারতের দালাল নন সেটাও বারবার জনগণকে বোঝাতে হয়েছিল। নির্বাচনের আগে এবং পরে শেখ হাসিনা ঘটা করে উমরাহ পালনও করেছিলেন। আর ২০২৪ সালে জনগণ কি ভাবলো তার কোনরকম তোয়াক্কা না করে দলটির সাধারণ সম্পাদক বলতে পারেন, “দিল্লিও আছে আমরাও আছি” এবং “ভারত পাশে ছিল বলেই আমরা ২০২৪ সালের নির্বাচন করতে পেরেছি”। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, “আমি ভারতকে যা দিয়েছি সেটা কোনদিন তারা ভুলবে না”। ২০২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পবিত্র রমজান নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের হিন্দু এবং মুসলমান নামধারী হিন্দুত্ববাদী সদস্যরা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে রোজদার ছাত্রদের পিটিয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে পাঠায়। ওদিকে সেই মাসেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজার ৭২ টি মন্ডপ তৈরি হয়। অথচ, কথিত স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা মাত্র সাড়ে আট শতাংশ। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে সমবেত ইফতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সব দেখেও দেশের আলেম সমাজ নীরব থাকে! দেশ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, ওসি প্রদীপ সরকার অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ খান সিনহাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার পর মৃতদেহের মুখে বুটজুতো দিয়ে লাথি মেরে মরে গেছে কিনা দেখতে পারে। ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের বিপ্লব সরকার বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে তাণ্ডব চালিয়ে তালা লাগানোর পর দলটির প্রবীণ সেক্রেটারি জেনারেল ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে ডজন ডজন সাংবাদিকদের সামনে দুর্ব্যবহার করে পার পেয়ে যায়। শ্যামল দত্তরা জাতীয় প্রেস ক্লাব দখল করে নেয়। মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশে মুসলমানরা সব কোথায় গেল?

১৯৯৬ সালে এক তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে সারা দেশের ইসলাম ধর্মপ্রাণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মাত্র তিরিশ বছরে দেশ অবিশ্বাস্যভাবে এতটাই পাল্টে যায় যে, ২০২৪ সালে গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বৃষ্টি খাতুন ইডেন কলেজে পড়তে এসে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী হয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়মিত পূজা করে। তার পুড়ে যাওয়া লাশের নাকি আবার সেই গ্রামে, এলাকার মুসল্লিদের কোন প্রতিবাদ ছাড়াই জানাজা হয়ে দাফন হয়। আমি নিশ্চিত, ১৯৯৬ সালে কোন মাওলানা এই জানাজা পড়তে সম্মত হতেন না। এমন কত বৃষ্টি খাতুনরা নানা লোভের কারণে অভিশ্রুতি সেজে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার হদিস পরিবার কিংবা সমাজ রাখে না। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী মুসলমানের সাংস্কৃতিক হিন্দুকরণের সূচনা পাকিস্তানী আমলেই শুরু হয়েছিল। শেখ হাসিনার টানা পনেরো বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনকালে সেই বিষবৃক্ষের শিকড় নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজেও বিস্তৃত হয়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের মুসলমানদের হিন্দুকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভারতের আদলে স্কুলকলেজের বইপুস্তকে বৃহত্তর বাংলায় মুসলমানের হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস পাল্টে ফেলা হচ্ছে। পনেরো বছরে সেই হিন্দুত্ববাদী শিক্ষায় মগজ ধোলাইকৃত প্রায় দুই প্রজন্ম বের হয়েছে। বৃষ্টি খাতুনরা সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি।
সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী চলচ্চিত্র, হীরক রাজার দেশে মগজ ধোলাইয়ের পর প্রাণশক্তি নিংড়ে নেয়া প্রজারা শ্লোগান দিত, হীরকের রাজা ভগবান। ২০৪১ সালের মধ্যে হিন্দুকরণ প্রক্রিয়া পুরোপুরি সম্পন্ন হলে কাঠালরাণীকে নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ হয়ত শ্লোগান ধরবে, মা দূর্গা রাণী হাসিনা। জীবিত থাকলে শেখ হাসিনা তখন প্রায় শতবর্ষী হয়ে যাবেন। এর মধ্যে আর তিন-চারটি প্রজন্ম বর্তমানের বিকৃত শিক্ষা দিয়ে মগজধোলাই প্রাপ্ত হলে, বাঙ্গালী মুসলমান জাতিস্বত্তারও অবসান ঘটবে। বাংলাদেশকে আর ভারতের রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না বলে ২০০৮ সালে ভারতের এক জেনারেল যে দম্ভোক্তি করেছিলেন তারই বাস্তবায়ন ২০৪১ পর্যন্ত হতে থাকবে।

আমি আশা করতে চাই, তারেক রহমান বাংলাদেশের বিপদ এখন উপলব্ধি করতে পারছেন। আমার ধারনা, কেবল আমেরিকার উপর ভরসা না করে, দুই বছর আগে থেকে যদি ভারত হঠানো এবং ফ্যাসিবাদী সরকারকে উৎখাত, এই দুই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা যেত তাহলে, ৭ জানুয়ারি জনগণ কেবল “ডামি ভোট” বর্জন করেই ক্ষান্ত হত না। বিশাল বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীদের আগে থেকে উদ্বুদ্ধ করা হলে, গত বছর ঢাকায় আঠাশে অক্টোবরের ইতিহাসও অন্যরকমভাবে লেখা হত। সফল রাজনীতিবিদদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, তারা ভুল করেছেন এবং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম চালিয়েছেন। প্রায় এক দশক ধরে বিএনপির যে সব নেতারা ভারত সম্পর্কে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে ভুল তথ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন তাদের এবার অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিৎ।

৭ জানুয়ারি অতীত হলেও ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই কিন্ত, চলমান। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিয়ে যে বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা হয়েছে তাকে বেগবান করা বাংলাদেশের সকল দেশপ্রেমিক এবং ইসলামের পক্ষের দল ও জনগণের কর্তব্য। ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম তৈরির কৌশলে বিএনপি প্রচুর ভুল করেছে। এবার ভারতীয় পণ্য এবং আগ্রাসী দেশটির দালাল, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পুরনো ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটানো যাবে না। বিএনপির যে সকল নেতারা ইসলামের কথা বলতে কিংবা ভারতের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে দ্বিধাবোধ করেন তাদের আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া উচিৎ। গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে রিজভী বিএনপির সঠিক আন্দোলনে ফেরার যে সম্ভাবনা জাগিয়েছেন, দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে তার ধারাবাহিকতার প্রত্যাশা রেখে আজকের সম্পাদকীয় সমাপ্ত করছি।

সম্পাদক, আমার দেশ