রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে পারছে না

টেকসই ও সবুজ শিল্পে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো। সর্বশেষ ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে টেকসই খাতে ২০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র ছয় শতাংশ। আর সবুজ খাতে পাঁচ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিতরণ করেছে মাত্র দেড় শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো টেকসই খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার অনেকটা কাছাকাছি যেতে পারলেও সবুজ খাতে একেবারেই নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর টেকসই ও সবুজ খাতে ঋণ বিতরণ পরিস্থিতি সন্তোষজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

টেকসই অর্থায়ন বলতে পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন, ঋণের গুণগত মান এবং কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখে, এমন খাতে ঋণ বিতরণকে বোঝায়। টেকসই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কৃষি, সিএমএসএমই, পরিবেশবান্ধব কারখানা, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্প প্রভৃতি। অন্যদিকে সবুজ প্রকল্পে অর্থায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, পানি ও কাগজের খরচ কমানোর উপযোগী প্রতিষ্ঠান ও কারখানাগুলোকে ধরা হয় সবুজ শিল্প হিসেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ২০২০ সালের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের অন্তত ২০ শতাংশ টেকসই প্রকল্পে বিতরণ করতে হবে। আর পরিবেশবান্ধব খাতে মোট মেয়াদি ঋণের পাঁচ শতাংশ ঋণ বিতরণের শর্ত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই শিল্পের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে এই দুই খাতে অর্থায়ন বাড়াতে নীতিমালা জারি করে টার্গেট বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও আশানুরূপ ঋণ বিতরণ করতে পারছে না অনেক ব্যাংক। এ তালিকায় সবচেয়ে পিছিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ছয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের শেষ তিন মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো টেকসই প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে এক হাজার ৮২৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের মাত্র ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকগুলো সবুজ খাতে ঋণ দিয়েছে ২৫২ কোটি টাকা, যা তাদের মেয়াদি ঋণের মাত্র ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলো টেকসই প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে তিন হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। একই সময়ে সবুজ খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে মাত্র এক কোটি ৭৫ হাজার টাকা, যা তাদের মেয়াদি ঋণের দশমিক ০৮ শতাংশ। এ সময়ে টেকসই খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৬০ হাজার ৬৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪০ দশমিক ১০ শতাংশ। একই সময়ে সবুজ খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে চার হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা, যা তাদের মেয়াদি ঋণের ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে ইসলামি ব্যাংকগুলো টেকসই খাতে ঋণ দিয়েছে ১৭ হাজার ১১২ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তবে সবুজ খাতে ইসলামি ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। এ খাতে ব্যাংকগুলো দিয়েছে এক হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলো টেকসই খাতে বিতরণ করেছে পাঁচ হাজার ১০৭ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। একই সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলো সবুজ খাতে ঋণ দিয়েছে ১২২ কোটি টাকা, যা তাদের মেয়াদি ঋণের ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

অন্যদিকে গত বছরের শেষ তিন মাসে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে দুই হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। একই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবুজ খাতে ঋণ দিয়েছে ৯৯৬ টাকা, যা তাদের মোট মেয়াদি ঋণের ১৫ দশমিক ১৩ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত, ইসলামি, বিদেশিসহ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণে পিছিয়ে থাকায় ২০২৩ সালের পুরো সময়েও টেকসই শিল্পে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ হয়নি। গত বছর টেকসই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণ হয়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। ঋণ বিতরণের এই হার ২০২২ সালের চেয়ে অনেক বেশি। ২০২২ সালে টেকসই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের হার ছিল ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর ২০২১ সালে এ হার ছিল আরও কম, মাত্র আট শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর সবুজ খাতে ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। ২০২৩ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, ২০২২ সালে যা ছিল ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর ২০২১ সালে এ খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছিল মাত্র তিন শতাংশের মতো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে ২০২১ সাল থেকে বিভিন্ন মানদণ্ডে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই রেটিং বা মান প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবছর ১০টি ব্যাংক ও পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এ রেটিংয়ে যুক্ত করা হচ্ছে। এই রেটিংয়ে জায়গা পাওয়ার অর্থ হচ্ছেÑসংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই ও সবুজ অর্থায়নে ভালো করছে। পাঁচটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই মান যাচাই করা হয়। এগুলো হলো টেকসই অর্থায়ন সূচক, সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম, পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়ন, টেকসই কোর ব্যাংকিং সূচক ও ব্যাংকিং সেবার পরিধি। এ রেটিংয়ের উদ্দেশ্যই হলোÑএ খাতে অর্থায়ন বাড়াতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা।

share biz