ঢাকার উপকণ্ঠে সাভারের রানা প্লাজা ধসের ১১ বছরেও খুনের মামলার বিচার শেষ হয়নি। মামলার ৫৯৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৮৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এত দিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় দীর্ঘদিন মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ ছিল। এক বছরের বেশি সময় ধরে নিয়মিত সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গত জানুয়ারিতে খুনের মামলাটি ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা চালাচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ।
মামলার তথ্য বলছে, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৫ জন নিহত ও ১ হাজার ১৬৯ জন গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হন। ওই ঘটনায় মোট মামলা হয় ২০টি। এর মধ্যে তিনটি হচ্ছে ফৌজদারি মামলা। শ্রমিক নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলা করে পুলিশ। অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
খুনের মামলা ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। ইমারত আইনের মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ রয়েছে।
খুনের মামলার বিচারে কেন দেরি
মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, খুনের মামলায় তদন্তে গেছে দুই বছর। মামলায় ছয় সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি না পাওয়ায় তদন্ত শেষ করতে দেরি হয়। তখন জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয় বলেছিল, যাঁরা বড় অপরাধ করেননি, তাঁদের অভিযোগপত্রভুক্ত করার অনুমতি দেবে না তারা। অবশ্য অনুমোদন না পেলেও তাঁদের আসামি করে ২০১৬ সালে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর মামলার অভিযোগ গঠনের আদেশ হয় আরও এক বছর পর।
তবে অভিযোগ গঠনের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে মামলার সাত আসামি উচ্চ আদালতে আবেদন করলে তাঁদের পক্ষে বিচারকাজ স্থগিতাদেশের রায় আসে। এ কারণে পাঁচ বছর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ ছিল। পরে ছয়জনের পক্ষে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
অভিযোগপত্রভুক্ত তিন আসামির মৃত্যু হওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আসামি ৩৮ জন। তাঁদের মধ্যে কেবল রানা প্লাজার মালিকের ছেলে সোহেল রানা কারাগারে।
ভুক্তভোগী নিলুফা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসে আমার মতো বহু শ্রমিক পঙ্গু হয়ে গেছে। এমন নৃশংস ঘটনার ১১ বছর পরও বিচার শেষ হয়নি। জানি না, কবে সোহেল রানাদের শাস্তি হবে।’
ভুক্তভোগী অন্তত পাঁচজন প্রথম আলোকে বলেছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করলেও আজও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
ইমারত আইনের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ
রানা প্লাজা ভবন নির্মাণে ত্রুটি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরের বছর ২০১৬ সালের ১৪ জুন অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। তবে ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে আবেদন করেন।
অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।
এ ছাড়া ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে। এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে।
পোশাকশ্রমিক নেতা কল্পনা আক্তার গত সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ধসে ১ হাজারের বেশি শ্রমিক মারা গেলেন; অথচ এই খুনের মামলার বিচার এগোয় না। বছর ঘুরে ২৪ এপ্রিল এলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, মামলা নিষ্পত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। বাস্তবিক অর্থে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এ খুনের মামলার বিচার অনেক আগেই নিষ্পত্তি হতো।
prothom alo