২৩ জুলাই ২০২২
চৌদ্দ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের পরিণতিতে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিকেই বিনাশ করেছেন। এই সময়কালে জনগণের সকল অধিকার হরণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ধ্বংসসাধন করা হয়েছে। ভুয়া উন্নয়নের প্রচারের আড়ালে বিশ্বকে ধোকা দিয়ে আওয়ামী সরকার অচিন্তনীয় লুটপাট চালিয়েছে। লুটপাটের উদাহরণ হিসাবে এর আগের সম্পাদকীয়তেই লিখেছিলাম যে কিভাবে শেখ হাসিনা ২২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ৩.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প রাশিয়ার কাছ থেকে ১৩.৫ বিলিয়ন ডলারে ক্রয় করে রাষ্ট্রের ১০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ১০০,০০০ (এক লক্ষ) কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন। আওয়ামী ব্যবসায়ীদের লুটপাটে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সকল সরকারী ও বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক তাদের হাতে অর্পণ করেছেন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছে সেটি কাটিয়ে উঠতে হাসিনার পতনের পরও দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হবে। শেখ হাসিনার অপশাসন চলতে থাকলে ২০২৩ সাল শেষ হওয়ার আগেই সতেরো কোটি জনসংখ্যার, পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশটি শ্রীলংকার অবস্থায় পৌঁছাবে। অর্থনীতির অনেকগুলো মৌলিক সূচকের মধ্যে কেবল একটি, বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পাঠকদের অর্থনৈতিক অবস্থার ভয়াবহতা বোঝানোর চেষ্টা করছি।
আই এম এফের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন ৩১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশের ‘চলতি হিসাবে’ প্রতিমাসে ঘাটতি প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার। ‘চলতি হিসাবের’ অর্থ হলো, রাষ্ট্র যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে (রপ্তানি আয়, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রেরিত অর্থ এবং বিদেশে রাষ্ট্রের কোন বিনিয়োগ থাকলে তার মাসিক/বাৎসরিক আয়) বিয়োগ যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় (আমদানি খরচ, প্রকল্প ব্যয়, এবং বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ)। অর্থাৎ চলতি হিসাবের ঘাটতি বর্তমান অবস্থায় অব্যাহত থাকলে এবং নতুন বিদেশি ঋণ না পাওয়া গেলে বাংলাদেশের রিজার্ভ মাত্র ২০ মাসের মধ্যে একেবারে শুন্য হয়ে পড়বে। স্মরণে রাখা দরকার যে, একটি দেশ দেউলিয়া ঘোষণা হতে রিজার্ভ একেবারে শুন্য হতে হয় না। গত এক বছরের কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলারের অধিক। আর অতিরিক্ত ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমলেই এ দেশের কোন ঋণপত্র (এল সি) বিদেশের কোন ব্যাংক আর গ্রহণ করবে না। সে ক্ষেত্রে শ্রীলংকার মতই জ্বালানি তেল, এমনকি খাদ্যদ্রব্যও আমদানি করা যাবে না। গত ছয় মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। তারপরও প্রতিদিন ডলারের মূল্য ১ টাকা থেকে ২ টাকা হারে বাড়ছে। সুতরাং, শেখ হাসিনার ধ্বংসাত্বক শাসন বজায় থাকলে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ দেউলিয়া রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে আমি আশংকা করছি।
শেখ হাসিনাও তার বিপদ বুঝতে পারছেন। সে জন্যেই মুখে নানারকম বড়াই করলেও, ঋণের জন্য অর্থমন্ত্রি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রিকে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে পাঠাচ্ছেন। ইতোমধ্যে আই এম এফের একটি দল প্রাথমিক জরিপ করতে বাংলাদেশে ঘুরেও গেছে। তারা বাংলাদেশের হাল আমলের পরিসংখ্যানের বিভিন্ন জালিয়াতি ধরার পর সেগুলো সংশোধনের পরামর্শ দিলে সেটি সরকার গ্রহণ করে নাই। ফ্যাসিস্ট শাসকের মুশকিল হলো যে, এই সব জালিয়াতি বাদ দিলে অর্থনীতির বিবর্ণ চেহারা আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তার এতোদিনের ‘গণতন্ত্র বাদ দিয়ে উন্নয়নের’ শ্লোগানের অন্ত:সারশুন্যতাও প্রমাণিত হয়ে পড়বে। আই এম এফের শর্ত না মানলে ঋণ মিলবে না বুঝতে পেরে অর্থমন্ত্রি এখন বলছেন যে, বাংলাদেশ সরকার আই এম এফ থেকে ঋণ নেবে না। দুর্ভাগ্যবশত:, বাংলাদেশের গোলাম মিডিয়ায় এমন একজন সাংবাদিকও নেই যে কিনা লুটেরা সরকারের দুর্নীতিবাজ অর্থমন্ত্রিকে একটি সহজ প্রশ্ন করবে, ঋণ না চাইলে আই এম এফকে কেন ডেকেছিলেন? তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া আই এম এফ বাংলাদেশকে কোন সহায়তাও করবে না। এদিকে হাসিনার ‘ইসলামী জঙ্গী কার্ড’ অকার্যকর হয়ে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ক্ল্যাসিকাল ফ্যাসিস্টের অবধারিত পরিণতির দিকেই শেখ হাসিনা দ্রুত এগোচ্ছেন।
জনরোষ থেকে রক্ষা পেতে যে কোন মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করা ব্যতিত আর কোন বিকল্প বাংলাদেশের ৫১ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস এই নারী স্বৈরশাসকের হাতে নেই। তাই গত এক মাসের মধ্যে শেখ হাসিনা তার ‘ডেথ স্কোয়াডের’ অন্যতম দুই সদস্যকে পুরষ্কৃত করে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। প্রথমে তিনি খুনি ও চরম দুর্নীতিবাজ হারুনকে ডিবি পুলিশের প্রধানের পদে বসিয়েছেন। তারপর এই সপ্তাহে বাংলাদেশে গুমখুনের অন্যতম প্রধান হোতা, ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসানকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল বানিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশসমূহকে তোয়াক্কা না করার বার্তাও দিয়েছেন। শেখ হাসিনা ধরে নিয়েছেন যে, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আর যেহেতু ছাড় পাওয়া যাবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, সেক্ষেত্রে দিল্লি এবং বেইজিং এর উপর পুরোপুরি নির্ভর করাই একমাত্র বিকল্প। তাছাড়া মার্কিন স্যাংকশনের ফলে সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে এক প্রকার ভীতি সৃষ্টি হওয়ায় তিনি তাদেরকে ভারত ও চীনের অব্যাহত সমর্থনের আশ্বাস দিতে চাচ্ছেন। মার্কিন স্যাংকশন প্রত্যাহার করাতে শেখ হাসিনা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে বর্তমান সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত হতে উভয় বাহিনীতেই যথেষ্ট দ্বিধা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাহিনীতে গুঞ্জন চলছে যে, ফ্যাসিবাদি শাসককে সমর্থনের মূল্য আখেরে সেনাবাহিনী ও পুলিশকেই চুকাতে হবে। শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিস্ট শাসন রক্ষার প্রয়োজনে সকল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নমূলক কর্মকান্ডে ভারত এবং চীনের নিরংকুশ সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে পর্যন্ত সম্প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছেন।
ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশ অবধারিতভাবে আর একটি মিয়ানমারে পরিণত হতে চলেছে। সেখানে সামরিক জান্তার সকল প্রকার জুলুমে চীন প্রকাশ্যে এবং ভারত নীরবে সমর্থন দিচ্ছে। এশিয়ার এই দুই প্রবল শক্তির আশকারাতেই মিয়ানমার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাতে পেরেছে। অং সাং সুচি আবারও কারাগারে গিয়ে তার মুসলমানবিদ্বেষ ও আপোষকামিতার মূল্য দিচ্ছেন। মিয়ানমারে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিও সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনা সম্ভবত: মিয়ানমার থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আরো একটি তামাশার নির্বাচন করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা করছেন। তবে অর্থনীতির চরম ভঙ্গুর অবস্থা দেখে আমি মনে করি সেই পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট সরকারের টিকে থাকা খুবই কঠিন হবে। বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামলে শেখ হাসিনার পতন ত্বরান্বিত হওয়ার পাশাপাশি দেশের সর্বনাশের মাত্রাও কম হতো। আর তারা এভাবেই নিরাপদ দূরত্বে বসে থেকে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখলে হাসিনার সঙ্গে বিরোধী নেতৃত্বও জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলে আমি বিস্মিত হব না।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ, ২৩-০৭-২০২২