জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদি শাসনের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন আন্দোলন নেই। এবার সভা-সেমিনার কেন্দ্রিক বক্তৃতায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী বক্তব্যের বিষয়েও সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে বিরোধী দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপি। মাঠের আন্দোলন থেকে বিরত থাকা রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ভরসা ছিল প্রেসক্লাব ভিত্তিক সভা সেমিনারে অংশ নিয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী বক্তৃতা ও সরকারের সমালোচনা শোনা। এখন সেখান থেকেও বিরত থাকতে বিএনপি নেতাকর্মীদেরকে মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রেসক্লাব কেন্দ্রিক নানা ইস্যুতে সভা সেমিনারের আয়োজন হয় নিয়মিত। এসব সভা সেমিনারে বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি পেশাজীবী ও স্বতন্ত্র বুদ্ধিজীবীরা আমন্ত্রিত হয়ে বক্তব্য রাখেন। কখনও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি’র নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় এসব সভা সেমিনারে। বিএনপি নেতাকর্মীরা উপস্থিত থাকলেও এসব সমালোচনার তাৎক্ষণিক জবাব দেয়া তাদের পক্ষ সম্ভব হয় না। সমালোচনা হজম করেই সভা-সেমিনার থেকে ফিরতে হয় তাদের। এজন্য এসব সভা সেমিনারে উপস্থিত না হওয়ার জন্য বিএনপি’র নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দলটির হাইকমাণ্ড থেকে।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মান নিয়ে সরকারি অপকৌশলের বিষয়েও বিএনপি রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মান নিয়ে দেশের আলেম সমাজের বিরোধীতা এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের মামলা দিয়ে কোনঠাসা করার অপচেষ্টার বিষয়েও বিএনপি নীরব। এমনকি আওয়ামী হাইকোর্টের পক্ষ থেকে দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় মূর্তি নির্মানের নির্দেশনার বিষয়েও তাদের কোন শব্দ নেই। শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তির সাথে সংবিধানকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তাহলে কি নীরবে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মানে বিএনপি সমর্থন জানাচ্ছে, এনিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
অপর দিকে ১৪ ডিসেম্বর পেশাজীবী পরিষদের আলোচনা সভা শেষে প্রেসক্লাব থেকে গুলিস্তানের জিরোপয়েন্ট হয়ে মুক্তাঙ্গনে জমায়েতে যোগ দেয়ায় বিএনপি’র অনেক নেতাই এখন তোপের মুখে রয়েছেন। এই জমায়েতে অংশ নেয়ায় ইতোমধ্যে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ও পেশাজীবী নেতা শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছিল দলের পক্ষ থেকে। বৃহস্পতিবার তিনি জবাব দিয়েছেন। এছাড়া দলীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য দেয়ায় আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মেজর অব: হাফিজকে ৫দিন সময় দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। শনিবার তিনি জবাব দেবেন বলে জানা গেছে। লিখিত জবাবের পাশাপাশি শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে তাঁর । তিনি কি জবাব দেন এবং সংবাদ সম্মেলনে কি বলেন, এ নিয়েও বিভিন্ন মহলে কৌতুহল রয়েছে। ১/১১-এর জরুরী আইনের সময় বিএনপি ভাঙ্গার উদ্যোগে সক্রিয় এই নেতাকে নিয়ে নানা গুঞ্জণ রয়েছে রাজনীতিতে।
মেজর অব: হাফিজ এবং শওকত মাহমুদ ছাড়াও আরো কয়েকজনের ওপর দলের হাই কমাণ্ড থেকে সতর্ক নজরদারি করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এই নজরদারির আওতায় সাবেক একাধিক ছাত্রনেতাও রয়েছেন। সূত্রটি জানায়, ডাকসুর সাবেক ভিপি নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, ডাকসুর সাবেক ভিপি বর্তমানে আলোচিত ছাত্রনেতা নুরুল হক নুর, মেজর জেনারেল অব: সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমসহ আরো কয়েকজন রাজনীতিকের নেতৃত্বে নূতন পোলারাইজেশনের উদ্যোগ রয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকার বিরোধী আন্দোলনকে চাঙ্গা করতেই তারা নূতন পোলারাইজেশনে সক্রিয়। এতে বিএনপি’র কয়েকজন নেতার সায় রয়েছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে রাজনীতিতে। এমন উদ্যোগের খবরের ভিত্তিতেই বিএনপি হাইকমাণ্ড দলটির কয়েকজন সন্দেহভাজন নেতার প্রতি নজরদারি রাখছেন।
এদিকে মাহমুদুর রহমান মান্না, নুরুল হক নুরু, সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমরা পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। নানা ইস্যুতে তাদেরকে রাজপথে মিটিং, মিছিল করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। সম্প্রতি ধর্ষণের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা আন্দোলনে মাহমুদুর রহমান মান্না এবং নুরুল হক নুরু, জুনায়েদ সাকীসহ বেশ কয়েকজনকে একমঞ্চে দেখা গেছে। নিয়মিত সভা, সেমিনার ও মিটিং-মিছিল করে সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে তাদেরকে । কিন্তু এই অবস্থায় বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি সোস্যাল মিডিয়া এবং জুমে প্রবেশ করেছে। রাজপথের রাজনীতি থেকে বিএনপি এখন কম্পিউটার ও ল্যাপটপে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। জুমেই সরকার পতনের কঠোর হুশিয়ারিমূলক বক্তব্য নিজেরা দিয়ে নিজেরাই শুনছেন।
অথচ, ফ্যাসিবাদি সরকারের নির্বাচনী ফর্মূলাকে কবুল করে প্রতিটি স্থানীয় এবং উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। শুক্রবারও দ্বিতীয় ধাপের পৌর নির্বাচনের জন্য ৫৫জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে দলটি। বলা হচ্ছে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সক্রিয় রাখতেই দলটি স্থানীয় এবং উপ-নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তবে এপর্যন্ত জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচনে অংশ নেয়া কোন প্রার্থী জামানত নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেনি। আগামী ২৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া পৌর নির্বাচনে ক’জন প্রাথী নির্বাচনের দিন টিকে থাকতে পারেন সেটা দেখার অপেক্ষায় দেশের জনগণ। বিএনপি’র এই কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট যে, দলটি পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্যই এখন অপেক্ষায় রয়েছে। যদিও ফ্যাসিবাদের অধীনে নির্বাচন কেমন হয়, এর জ্বলন্ত উদাহরণ রয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে। এই দুই জাতীয় নিবাচন এবং পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন গুলো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ফ্যাসিবাদের অধীনে নির্বাচন কেমন হয়। তারপরও ফ্যাসিবাদকে সহযোগিতা করতেই কি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, এমন প্রশ্ন এখন দলের নেতাকর্মীরাও করছেন।
বিএনপি’র রাজপথের রাজনীতির নীরবতায় ২০ দলীয় জোটেরও কোন খবর নেই। স্থানীয় এবং উপ-নির্বাচনেও জোটের কোন অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এই জোটের অস্তিত্ব এখন আছে, নাকি জোট বিলীন হয়ে গেছে সেটাও স্পষ্ট নয়।