নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় রাজনৈতিক সহিংসতা গ্রাস করেছে বাংলাদেশকে। ২৮শে অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ চলাকালে সংঘটিত সহিংসতার জন্য ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপি একে অন্যকে দায়ী করছে। কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক তীব্র উত্তেজনার পর বাংলাদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও রক্তপাত শুরু হয়েছে। এতে জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশকে প্রান্তসীমায় নিয়ে গেছে। অনলাইন বিবিসিতে প্রকাশিত আনবারাসান ইথিরাজনের লেখা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। তিনি আরও লিখেছেন, বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে। এতে বিরোধী দলের কমপক্ষে দু’জন সমর্থক নিহত হয়েছেন। এর পরদিনই বিরোধী দলের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি আরও লিখেছেন, প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ জোরালো করেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। তাদের যুক্তি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
তাদের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ২৮শে অক্টোবর এ দাবিতে বিএনপি ঢাকায় যে মহাসমাবেশ করে তাতে লাখো মানুষ সমবেত হন। এক দশকের মধ্যে এটাকে সবচেয়ে বড় অন্যতম জনসমাবেশ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু খুব শিগগিরই তা সহিংস হয়ে ওঠে। তাদের দিকে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। অন্যদিকে বিএনপির সমর্থকরা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। এ সময় রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। বিস্ফোরণ ঘটানো হয় সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস। রাস্তায় পড়ে থাকে ভাঙা কাচ।
ইথিরাজন আরও লিখেছেন, এই সহিংসতা শুরুর জন্য উভয় পক্ষ একে অন্যকে দায়ী করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বিবিসিকে বলেছেন, পুলিশ, সাংবাদিক, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, প্রধান বিচারপতি সহ অন্য বিচারপতিদের বাড়িতে হামলা করে বিরোধী দলীয় সমর্থকরা বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। তবে বিএনপি বলেছে অন্যকথা। দলটির সিনিয়র নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, তাদের মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণ ও অহিংস ছিল। কিন্তু মানুষের ঢল দেখে সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাই তারা বিএনপির মিটিং ভণ্ডুল করার সিদ্ধান্ত নেয়। র্যালিতে দুইদিক থেকে আক্রমণ চালানো হয়েছে। যেন এটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র। তাই আমাদেরকে মাঝপথে সমাবেশ বন্ধ করে দিতে হয়। তবে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বিরোধীদের সমাবেশে যোগ দেয়া নেতাকর্মীদের উস্কানি দেয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রতিবাদে বিএনপি মঙ্গলবার থেকে তিনদিনের জন্য দেশজুড়ে অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে এরই মধ্যে অনেক বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার সংঘর্ষ চলাকালে বিরোধী দলের দু’জন কর্মী নিহত হয়েছেন। সহিংসতার ভয়ে বেশির ভাগ যানবাহন রাস্তায় নামেনি।
ইথিরাজন আরও লিখেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশে কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বছরের পর বছর রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দাবি আদায়ের জন্য রাজপথকে বেছে নিয়েছে। এর ফলে এসেছে শাটডাউন, সহিংসতা এবং প্রাণহানি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক বিভেদ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিক্ততা বেড়েছে। আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতার দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি আছে। তারা টানা চতুর্থবার ৫ বছরের জন্য আবার ক্ষমতায় থাকতে চাইছে। প্রধান দুটি দল সমঝোতার মানসিকতায় নেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে সংলাপের সুযোগ কমে আসছে বলেই মনে হচ্ছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতির মামলায় ৫ বছর আগে জেল দেয়া হয়েছে। তারপর থেকে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাকে সহ বিএনপির অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৮ বছর। কার্যত তিনি এখন গৃহবন্দি। তিনি এবং ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা- তারা দু’জনেই রাজনৈতিক উত্তরসুরি। কমপক্ষে তিন দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন তারা। দু’জনের মধ্যে আছে তিক্ত বিরোধিতা। স্থানীয়ভাবে তাদেরকে ‘ব্যাটলিং বেগমস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মুসলিম নারীদের উচ্চ পদ বোঝাতে বেগম শব্দ ব্যবহার করা হয়।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। তখন থেকে তার দল আরও দুটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে, যদিও এসব নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ আছে। দেশ যখন কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে, বেশির ভাগ ভোটার ক্রমবর্ধমান জীবনধারণের খরচ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, বিশেষ করে খাদ্যের উচ্চমূল্য, সেপ্টেম্বরে যখন মুদ্রাস্ফীতি শতকরা প্রায় ৯.৬ ভাগ- তখন নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারে। তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানোর জন্য এই অর্থ যথেষ্ট নয়। সহায়তার জন্য এ বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয় সরকার।
বিবিসি আরও লিখেছে, যদিও বাংলাদেশে বিরোধীদের বড় প্রতিবাদ বিক্ষোভ অস্বাভাবিক নয়, তবু বিশ্লেষকরা বলছেন- খাদ্যের উচ্চ মূল্য নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষের কারণে এসব বিক্ষোভে বিপুল পরিমাণ মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছেন। আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, অর্থনীতি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। জনগণ ধুঁকছে। এ জন্যই পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে, গ্রেপ্তার এবং ভীতি প্রদর্শন করে জনগণকে আমাদের র্যালিতে যোগ দেয়া বন্ধ করতে চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। তা সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ আমাদের জনসমাবেশে যোগ দিচ্ছেন। অন্যদিকে দেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর ধরে তার শাসনের অধীনে দেশে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলছেন।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মহাসমাবেশের পর বিরোধী দলের কয়েক শত সমর্থক সহ মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তারের ফলে অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো থেকে সমালোচনা জোরালো হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সপ্তাহান্তে যে তীব্র দমনপীড়ন চালানো হয়েছে, তা বাংলাদেশে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে পুরোপুরি দমনপীড়নের ইঙ্গিত দেয়। সরকারকে সংযম এবং সব নাগরিকের জন্য মানবাধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে সমুন্নত রাখা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনারের অফিস। এরই মধ্যে বড় আকারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে। বিএনপির অভিযোগ, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে তাদের কয়েক শত সমর্থক জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের কারো কারো বিরুদ্ধে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে সরকার। কিন্তু এসব অভিযোগ তদন্তে আসতে চান যেসব বিদেশি সাংবাদিক তাদের সফরের ক্ষেত্রে ভয়াবহরকম বিধিনিষেধ আছে।
প্রথম সারির নারী অধিকারকর্মী শিরীন হক বলেছেন, সুনির্দিষ্টভাবে ভীতির পরিবেশ আছে, বিশেষ করে ডিজিটাল ফোরামে যেকোনো রকম ভিন্নমত প্রকাশ করলে। কারণ, লোকজনকে জেলে ভরতে সরকার ব্যবহার করে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, সমালোচনাকে বন্ধ করতে ও মুক্তমতকে গলা টিপে ধরতে এই আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে এই আইন কার্যকর হওয়ার পর সাংবাদিক, রাজনীতিক ও অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে এক হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। জাতিসংঘ সহ ব্যাপক বিরোধিতার পর সরকার সম্প্রতি এই আইনটি বদলে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন করে। কিন্তু অধিকারকর্মীরা বলছেন, নতুন এই আইনও নিষ্পেষণের হাতিয়ার। মিসেস শিরীন হক বলেন, জানুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করবে সরকার এমন কোনো আস্থা তার নেই। বিরোধীদের অভিযোগও একই। এ জন্য তারা নির্বাচনের আগে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করছে। নিরাপদ এই ব্যবস্থাকে পার্লামেন্ট বাতিল করে দিয়েছে ২০১১ সালে।
বিরোধীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, কোনো দেশে এমন কোনো ইতিহাস নেই যে, ক্ষমতাসীন সরকার পদত্যাগ করবে এবং সরকার পরিচালনার জন্য অনির্বাচিত ব্যক্তিদের অনুমতি দেবে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। তাই এ জাতীয় দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।
যদি দাবি পূরণ করা না হয়, তাহলে জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়েছে বিএনপি। আগে এই কৌশল তাদের পক্ষে যায়নি। তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাতে আওয়ামী লীগকে আরেকটি ভূমিধস জয় পেতে সহায়ক হয়েছে। কঠোর অবস্থান নেয়ার কারণে বাংলাদেশিরা রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাজপথে আরও সহিংসতার আশঙ্কা করছেন।