- সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীরপ্রতীক
- ৩১ ডিসেম্বর ২০২১
ঘটনাবহুল বছর পার
একটি ঘটনাবহুল বছর পার হলো। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগবে, সবচেয়ে বড় বড় ঘটনাগুলো কী? বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল, করোনা-আক্রমণ থেকে সাময়িক বা আপাত-মুক্তি। দ্বিতীয় বড় ঘটনা যেটি এখনো চলমান, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছর- এর ঘটনাগুলো। তৃতীয় ঘটনাটি একদম বছরের শেষের দিকের ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার ঘটনা। ছোট ছোট ঘটনার শেষ নেই। নৌপথে দুর্ঘটনা, সড়কপথে দুর্ঘটনা, অবিশ্বাস্য দুর্নীতি, দু’-একটি ব্যতিক্রমী বিচারিক রায়, যুগপৎ চাঞ্চল্যকর ও রোমান্টিক ঘটনা ইত্যাদি। প্রত্যেকটি বড় বা ছোট ঘটনা নিয়ে আলাদা আলাদা কলাম লেখা যায়; কিন্তু রাজনৈতিক ব্যস্ততায় নিজের কলাম লেখার সময় কমে এসেছে বিধায় পাঠকের সামনে এগুলো উপস্থাপন করতে পারছি না। করোনা আক্রমণ চলাকালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক করোনা দুর্যোগ মোকাবেলা প্রসঙ্গে ডজন ডজন কলাম লেখা হয়েছে, ডজন ডজন টকশো অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং হতে থাকবে। তাই সেদিকে মন দিচ্ছি না। আমি বরং করোনা আক্রান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হওয়া সঙ্কট ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্কট নিয়ে দু’টি কথা জাতির সামনে উপস্থাপন করছি। আজকের এই একটি কলামে কুলাবে না বিধায় পরপর দু’টি কলাম ইংরেজি বছরের শুরুতেই জনপ্রিয় পত্রিকা নয়া দিগন্তের মাধ্যমে তুলে ধরছি।
মুক্তিযুদ্ধ : অসমাপ্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া
রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার চিন্তা-চেতনায়, ভাব প্রকাশে মুক্তিযুদ্ধ আসবেই, থাকবেই। চূড়ান্ত পর্যায়ে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধটি ছিল একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সমাপনী পর্ব। ওই দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রকাশ্য লক্ষ্যবস্তু ছিল, পাকিস্তান নামক দেশের পূর্বপাকিস্তান নামক প্রদেশের জন্য স্বাধিকার বা স্বায়ত্তশাসন আদায় করা। অ-প্রকাশ্য লক্ষ্য ছিল পূর্বপাকিস্তান নামক প্রদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করা। সেই মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বছরে এসে মনে করি, মুক্তিযুদ্ধটি যেমন কি না একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সমাপনী পর্ব ছিল, তেমনি সেই একই মুক্তিযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রারম্ভিক পর্বও বটে। প্রারম্ভিক পর্বটি ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং তখন শুরু হওয়া প্রক্রিয়াটিও অবশ্যই একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যেটি এখনো চলমান। ১৯৭১ থেকে চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটির লক্ষ্যবস্তু ছিল এবং আছে এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যেখানে সমাজে মানুষে মানুষে সাম্য বিদ্যমান থাকবে, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং সমাজে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত থাকবে। এই লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হয়েছে বা হয়নি, সেটি অবশ্যই আলোচনা করা যায়। সেই আলোচনা গত এক-দুই বছর ধরে বিশেষ গুরুত্বের সাথে চলছে এবং আগামী এক-দুই বছরও চলবে বলে মনে করি। তবে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হওয়া ওই প্রক্রিয়ার ৫০তম বছরের শেষাংশে বলতে পারি- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জন ও প্রতিষ্ঠা করায় আমাদের আরো অনেক পরিশ্রম করতে হবে। অন্তত চার শ’ জন প্রখ্যাত ব্যক্তির জবানে বলা যাবে- গণতন্ত্র, সুশাসন, সুবিচার এখনো অধরা। চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মতে, একটি কল্যাণকামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। বাংলাদেশের বড়-ছোট সব জাতিগোষ্ঠীকে এক সুতায় গেঁথে প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করা হয়নি। এই সব অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করতে বা সমাপ্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাজনীতিবিদদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।
রাজনৈতিক সঙ্কটের ইশারা
যেহেতু আমি নিজে একজন রাজনৈতিক কর্মী, অতএব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক আশা-নিরাশার কথা আমার কলামে থাকতেই পারে। যত কিছুই বলি, একটি দেশের ও সমাজের উন্নতি ও অবনতি, যা কিছু হোক না কেন, এর দায়-দায়িত্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তথা রাজনৈতিক সরকারের ওপর বর্তায়। যে সময় যে সরকার থাকবে, সেই সরকারের ওপর বর্তাবে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত ডেমোক্র্যাসি কনফারেন্সে বাংলাদেশকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। উত্তর কোরিয়া ও মিয়ানমারের মতো বিশ্বব্যাপী অপ-খ্যাতিসম্পন্ন স্বৈরতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশকে একই কাতারে ফেলা হয়েছে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) আরোপ করা হয়। গণতন্ত্রপ্রেমী বাংলাদেশী জনগণের জন্য, ডেমোক্র্যাসি কনফারেন্সে দাওয়াত না পাওয়া এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির অভিজ্ঞতা লজ্জাজনক। বর্তমান সরকারের অমানবিক, অগণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার-বিমুখ কর্মকাণ্ডের জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে উত্তর কোরিয়া-মিয়ানমারের কাতারে ফেলেছে এবং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বলে পৃথিবী বিশ্বাস করে। মার্কিন সরকার এবং বাংলাদেশের মধ্যে আরো অনেক কিছু ঘটছে। ডিসেম্বরের ৯ দিন বাকি থাকতে প্রধানমন্ত্রী ছয় দিনের সরকারি সফরে মালদ্বীপ যান। মালদ্বীপ যাওয়াটা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, কিন্তু ছয় দিনব্যাপী সফরটা ব্যতিক্রমী। এ প্রসঙ্গে লেখালেখি সোশ্যাল মিডিয়াতে হয়েছে এবং হচ্ছে, মূল ধারার মিডিয়াতেও যৎকিঞ্চিৎ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো হবে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চিত হয়েছে এবং খোলা মনে সাহসের সাথে বলতে পারছে যে, আসলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটটি ঘনীভ‚ত হচ্ছে। এই কলামের লেখক সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক নিজেও জনগণের একজন হয়ে অনুভব করে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটটি ঘনীভ‚ত হচ্ছে। অতএব, এই সঙ্কটটির যৎকিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা প্রয়োজন এবং সঙ্কট উত্তরণের জন্যও সুপারিশ আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এই একটি কলামে কুলাবে না বিধায় ধারাবাহিকভাবে পরপর দু’টি কলাম উপস্থাপন করব।
সঙ্কট : মুদ্রার এক পিঠ
বাংলাদেশের জন্য যে রাজনৈতিক সঙ্কটটি ঘনীভ‚ত হচ্ছে, সেটিকে একটি মুদ্রা মনে করলে, ওই মুদ্রাটির দু’টি পিঠ পাওয়া যাবে এবং সব মুদ্রার মতোই তার একটি চক্রাকার চিকন সীমা আছে, কারণ মুদ্রাগুলো পাতলা হয়। রাজনৈতিক মুদ্রার দু’টি পিঠের একটি হলো ক্ষমতাসীনদের অঙ্গন, আরেকটি হলো ক্ষমতার বাইরের অঙ্গন। প্রথমে ক্ষমতাসীনদের কথা আলোচনা করি। ক্ষমতাসীন দলের নাম ‘আওয়ামী লীগ’। ক্ষমতাসীন জোটের নাম ‘১৪ দলীয় জোট’। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের প্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর সন্তান। প্রধানমন্ত্রীর নিজেরও সন্তান আছে। বঙ্গবন্ধুর জীবিত আরেকজন সন্তান আছেন। উভয় সন্তানের ঘরে সন্তানাদি তথা ওয়ারিশরা আছেন। বঙ্গবন্ধুর অতি ঘনিষ্ঠ নিকট আত্মীয়দের সন্তানাদি এবং ওয়ারিশরা আছেন। এটি একটি সম্মানিত বৃহৎ পরিবার। ইংরেজিতে বলা যায় ‘গ্রেটার ফ্যামিলি’। তাদের মধ্যে রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তি আছেন, রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা লালন করেন এমন ব্যক্তি আছেন এবং এটিই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর কয়েক বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সঙ্কটে ছিল। একটি পর্যায়ে, শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেন। নিজের দলের মধ্যে নেতৃত্ব সুসংহত করেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনালগ্নে ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজের পার্লামেন্টারি নেতৃত্ব সুসংহত করেছিলেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের প্রধান নেত্রী হিসেবে নিজের অবস্থানকে প্রস্ফুটিত করেন। গত ১৪ বছর একনাগাড়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে নিজেদের দলে ও জোটের ভেতরে নিজের গুরুত্বকে অবিসংবাদিত অবস্থানে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি অন্তত একটি কাজ দৃশ্যত করেননি। কাজটি হলো- তার উত্তরসূরি কে হবেন, সেটিকে আলোচনায় আনেননি। একটি সহজ উত্তর উপস্থাপন করে, এই প্রশ্নটিকে গুরুত্বহীন করে দেয়া কঠিন নয়। সেই সহজ উত্তরটি হলো- উদ্ধৃতি শুরু : ‘আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র মোতাবেক আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব অথবা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের মাধ্যমে তার উত্তরসূরি নির্বাচিত হবেন।’ কখন হবেন? এর উত্তর হলো- যখন প্রয়োজন হবে তখন।
অন্যান্য দেশের সঙ্কটগুলো ইঙ্গিতবহ
উন্নত বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দীর্ঘমেয়াদে নেতৃত্ব দেয়া শীর্ষ নেতার অবর্তমানে, আরেকজন শীর্ষ নেতা প্রস্তুত করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, জিম্বাবুয়ের শীর্ষ নেতা রবার্ট মুগাবের গদিচ্যুত হওয়ার পরের ঘটনা অথবা মাহাথির মোহাম্মদ নামক বিখ্যাত নেতা কর্তৃক স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার পর মালয়েশিয়ার ঘটনা অথবা সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার প্রখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পরের ঘটনা (যুগোশ্লাভিয়া নামক রাষ্ট্র খণ্ডিত হয়ে এখন একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র) অথবা প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পরের ঘটনা অথবা ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন গ্রেফতার হওয়ার পরের ঘটনা অথবা আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফিলিপাইনের একনায়ক ফার্দিনান্দ মার্কোস গদিচ্যুত হওয়ার পরে ফিলিপাইনের ঘটনা অথবা ইন্দোনেশিয়ার একনায়ক সুহার্তো গদিচ্যুত হওয়ার পরের ঘটনা। কয়েক শ’ বছর আগের ইতিহাসে গেলে, বাদশাহ আলমগীরের পরে মোগল সাম্রাজ্যের যে অবস্থা হয়েছিল সেটিও স্মরণযোগ্য। আমরা চাই, বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন বলয়টি যেন নিজেরাই বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনকে অস্থিতিশীল করার কারণ হিসেবে আবিভর্‚ত না হন।
জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অপরিহার্য উন্মেষ
বাংলাদেশের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান রাজনৈতিক দলের নাম ‘বিএনপি’। বিএনপির আনুষ্ঠানিক জন্ম শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই বহুদলীয় গণতন্ত্র স্থগিত হয়ে বাকশালের মাধ্যমে একদলীয় শাসনপদ্ধতি চালু হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত (শহীদ) হওয়ার পর হঠাৎ করেই বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফেরত যাওয়া সম্ভব ছিল না। বীর উত্তম জিয়াউর রহমান যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে থাকবেন, তখন তাকে এই সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছিল যে, তিনি কি বাকশাল পূর্ববর্তী কোনো রাজনৈতিক দলকে পুনরুজ্জীবিত করে সেটাতেই যোগ দেবেন নাকি নতুন দল গঠন করবেন? জিয়া যেহেতু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন তাই এই রাজনৈতিক ধারণাটিকে ধারণ করবে, লালন পালন করবে এবং এগিয়ে নিয়ে যাবে, এরকম একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন তার কাছে অনুভ‚ত হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিএনপির জন্ম। যে যত বড় নেতা হয়ে ওঠেন, তিনি ওই অনুপাতেই ভক্ত, অনুরক্ত, ভালোবাসার মানুষ পান; এটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য যে, তার প্রতি হিংসা বা তার প্রতি পরশ্রীকাতরতায় বৈরী পক্ষও জন্ম নেয়। এটি ইন্দিরা গান্ধী বা বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি শহীদ জিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বেগম জিয়া অধ্যায়
বীর উত্তম জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর এক বছর বিরতিতে সামরিক শাসন আসে। ওই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েই বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের মোহনীয়তা তথা ক্যারিশমা প্রস্ফুটিত হয়। তিনি আপসহীন দেশনেত্রী হয়ে ওঠেন। তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে আবার ছদ্মবেশী সামরিক শাসন আসে। সেই থেকে বিএনপি এবং বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সুনির্দিষ্ট বৈরিতা শুরু। ওই বৈরিতার উদ্দেশ্য ছিল, বিএনপির নেতৃত্বকে ঘায়েল করা। বিএনপির বা বিএনপির বৈরী পক্ষের ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করছি না। আমি আলোচনা করছি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কথা, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটটি সৃষ্টি হয়েছে এবং এখন একটি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। গত ১০ বছরের কথা বলি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন দু’টি রাজনৈতিক জোট ছিল বা আছে যথা ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ২০ দলীয় জোটের ২০ সংখ্যাটি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু জোট শব্দটি নিয়ে বিতর্ক নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের চার ভাগের দুই ভাগের সাড়াশব্দ নেই; দুই ভাগ সম্মানের সাথে সক্রিয়। ২০ দলীয় জোটের সুপরিচিত দল আছে হাতেগোনা কয়েকটি; নিবন্ধিত দল আরো কম। ২০ দলীয় জোট হোক অথবা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হোক, উভয়ের প্রধান শরিক তথা নেতা বিএনপি। বিএনপির চেয়ারপারসন ও জোট নেত্রী হলেন দেশনেত্রী বেগম জিয়া। আমার মতে, বিএনপির বৈরী পক্ষের রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তিনি ভঙ্গুর মামলার আসামি হয়েছিলেন, যার কারণে তিনি এখনো বন্দী। বন্দী থাকা অবস্থাতেই তার অতীতের অসুস্থতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্দিত্বের কারণে ও অসুস্থতার কারণে তিনি সক্রিয় নেতৃত্ব দিতে অপারগ। অতএব, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রাজনৈতিক আকাশের উজ্জ্বলতম তারকাটি বা একমাত্র সূর্যটি অস্তগামী।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যায়
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ দলীয় জোটেরও ভারপ্রাপ্ত প্রধান। কিন্তু এই কলামেই উপরের একটি অনুচ্ছেদে ক্ষমতাসীন রাজনীতির অঙ্গন নিয়ে যেমন আলোচনা করেছি, তেমনই অনুরূপ আলোচনা এখানেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও কারিশমার স্তরবিন্যাসে, দেশনেত্রী ছিলেন সর্বোচ্চ শিখরে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ওই পর্যায়ে যেতে সময় লাগবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনিও বাংলাদেশের বাইরে। অতএব এই নেতৃত্ব দিতে স্পর্শকাতরতা আছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বেগম জিয়ার স্থানে পৌঁছাতে সময় লাগবে এবং তাকে সেই সময় দিতে হবে। বিএনপির তরুণ স¤প্রদায় ও ২০ দলীয় জোটের বেশির ভাগ দল সম্ভবত সেই সময় দিতে প্রস্তুত। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার, বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্টেকহোল্ডাররা, বাংলাদেশবান্ধব বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সরকার এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক আবহাওয়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে সেই সময় দিতে প্রস্তুত কি না, এটি একটি কঠিন, স্পর্শকাতর ও বিব্রতকর প্রশ্ন। এই প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর আমার কাছে নেই।
যুদ্ধক্ষেত্রের টার্গেট নেতৃত্ব
যেহেতু একজন সৈনিক ছিলাম তাই যুদ্ধক্ষেত্রের অন্তত একটি তত্ত¡ রাজনীতির ক্ষেত্রেও আলোচনায় আনাটা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। যুদ্ধ হয় সাধারণত দু’টি পক্ষের মধ্যে। বাংলাদেশের রাজনীতিও প্রধানত দু’টি পক্ষের মধ্যে। যুদ্ধের ময়দানে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে চেষ্টা করে। বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানেও এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে চেষ্টা করে। যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যেকটি পক্ষই প্রথম টার্গেট করে নেতৃত্বের প্রতি। নেতৃত্বের উদাহরণটি বোঝার জন্য পাঠকের মনোযোগ, বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গন থেকে অল্প সময়ের জন্য অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছি। ১৪৪০ হিজরি বছর আগের ঘটনা; ওহুদের যুদ্ধের ময়দান; তখন মহানবী সা: ছিলেন মুসলমানদের সেনাপতি; আক্রমণকারী কুরাইশদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল মহানবী সা:-এর জীবনকে শারীরিকভাবে ক্ষতি ও হত্যা করা এবং কুরাইশরা হত্যা করতে না পারলেও গুরুতর আহত করতে পেরেছিল তাঁকে। আক্রমণকারীদের ধারণা ছিল, মহানবী সা: সশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকলে, মুসলমানরা নেতৃত্বের সঙ্কটে পড়বে। আরেকটি উদাহরণ। এখন থেকে ১৯-২০ বছর আগের ঘটনা; আমেরিকা যখন কুয়েত বিজয়ের পর ইরাক আক্রমণ করে, তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেফতার করা। কারণ সাদ্দাম পতন মানেই ইরাক-পতন।
এই উদাহরণগুলো হৃদয়ঙ্গম করার পর পাঠকের কাছে আবেদন করছি, বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে ফেরত আসুন। এক পক্ষের প্রধান সেনাপতির নাম শেখ হাসিনা, অপর পক্ষের প্রধান সেনাপতির নাম খালেদা জিয়া। যুদ্ধ শুরুর কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ নেই। আমি কয়েকটি তারিখ ও ঘটনা ক্রমিক নম্বর দিয়ে উল্লেøখ করছি। সম্মানিত পাঠক নিজে কষ্ট করে, প্রত্যেকটি ঘটনার তাৎপর্য বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা প্রভাব বিবেচনা করবেন। ১. ১৯৮১ সালের মে মাসে শেখ হাসিনার বাংলাদেশে আগমন। ২. ১৯৮১ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত (শহীদ) হন। ৩. ১৯৮১-৮২ সালে ১০ মাসের জন্য প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিচালনা এবং সেই সময় সেনাপতি জেনারেল এরশাদের রহস্যময় আচরণ। ৪. ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ। ৫. এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির জন্ম এবং ১৯৮৬ সালের নির্বাচন, যেখানে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী অংশ নেয়, বিএনপি নেয়নি। ৬. ১৯৮৮ সালের নির্বাচন, যেখানে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নেয়নি কিন্তু জাসদের নেতৃত্বে পার্লামেন্টে ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ সৃষ্টি করা হয়। ৭. ১৯৯০ সালের শেষ মাসে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন জোটের ও জামায়াতের চূড়ান্ত এরশাদবিরোধী আন্দোলন। ৮. ১৯৯১ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের নির্বাচনের ফলাফল, যেখানে বিএনপি-জামায়াত জোট গঠিত এবং ওই জোট ক্ষমতাসীন হয়। ৯. ১৯৯৫ সালের কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আন্দোলন, যেখানে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত যুগপৎ ছিল। ১০. ১৯৯৬ সালের ফেব্রæয়ারির একদলীয় নির্বাচন। ১১. ১৯৯৬ সালের ২০ মে সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। ১২. ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচন, যেখানে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও জাতীয় পার্টির ক্ষুদ্র কিন্তু অপরিহার্য সমর্থনে সরকার গঠন করে। ১৩. ২০০১ সালের নির্বাচন এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ক্ষমতা গ্রহণ। ১৪. ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনা তথা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হত্যা প্রচেষ্টা। ১৫. ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে বায়তুল মোকাররমের রাজপথে লগি-বৈঠার সংঘর্ষের ঘটনা। ১৬. ২০০৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নির্ধারণ করার নিমিত্তে বিতর্কিত প্রক্রিয়া। ১৭, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চার উপদেষ্টার পদত্যাগ। ১৮. ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জেনারেল মইন ইউ আহমেদের উদ্যোগে ছদ্মবেশী সামরিক অভ্যুত্থান। ১৯. মইন ইউ আহমেদের ভারত সফর, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সাথে বোঝাপড়া ও পরবর্তী সময়ে সাতটি ঘোড়া উপহার লাভ। ২০. ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী মহাজোট গঠন। ২১. ২৫ ফেব্রæয়ারির ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাযজ্ঞ। ২২. চিকিৎসার জন্য তারেক রহমানকে বিদেশ প্রেরণ। ২৩. বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বিদায়। ২৪. ২০১১ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের সংক্ষিপ্ত রায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে। ২৫. কেয়ারটেকার পদ্ধতি বাতিল সংক্রান্ত আইন পাস। ২৬. ২০০৯-১০ সাল থেকেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের তোড়জোড় ও প্রক্রিয়া যেটি এখনো চলমান। ২৭. ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর মধ্যে ঐতিহাসিক মোবাইল ফোনালাপ। ২৮. ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের একদলীয় নির্বাচন যেখানে ১৫৩ জন বিনাভোটে পার্লামেন্টে নির্বাচিত। ২৯. ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফর, এরশাদকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা। ৩০. ২০১৫ সালের অবরোধ ও বহুমুখী আগুন-সন্ত্রাস। ৩১. অবরোধ চলাকালে ফেব্রæয়ারি মাসে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু এবং আনুষঙ্গিক ঘটনা। ৩২. ২০১৮ সালের ফেব্রæয়ারিতে দেশনেত্রী গ্রেফতার। ৩৩. ২০১৮ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন। ৩৪. ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ভোট অনুষ্ঠান। ৩৫. ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে লাখ লাখ বিএনপি-জামায়াত তথা ২০ দলীয় জোটের কর্মীর বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা রুজু, যার কারণে কোটির উপরে নেতাকর্মী ঘরছাড়া, দেশছাড়া ও পেশাহীন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ইমেইল : [email protected]