গরু, গোমাংস ও গোহত্যা নিয়ে রাজনীতির কথকতা

প্তম শতাব্দীতে উত্তর প্রদেশে নির্মিত গাভী ও বাছুরের ভাস্কর্য – ফাইল ছবি

ভারতীয় উপমহাদেশে গরু, গোমাংস, গোমাতা, গোহত্যা, গোমূত্র ও গোবর নিয়ে বহু বিতর্ক ও সঙ্ঘাত চলে আসছে বহুকাল ধরে। হাল আমলে বিতর্কের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। গোমূত্র পান করলে এবং গোবর শরীরে মাখলে করোনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এমন কথা চাউর হলে দলে দলে মানুষ গো-মলমূত্র থেরাপি দিতে থাকে। ভারতের রাজস্থানে দুধের চেয়ে গোমূত্রের মূল্য বৃদ্ধি পায়। অথচ বিজ্ঞানীরা বলছেন, মলমূত্র পশুর বর্জ্য। রোগমুক্তির কথা কুসংস্কার মাত্র। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই; বরং এর মাধ্যমে নানা জীবাণু মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে (The International Journal of Health Planning and Management, 26 May, 2021)। গরু লালন ও ফ্রিজে গোমাংস সংরক্ষণের সন্দেহে পিটিয়ে মানুষ হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে ভারতে। কোনো মুসলমানের পক্ষে হালচাষের উদ্দেশ্যে গরু নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের জাতীয় নেতা গান্ধীজী ১৯৪৭ সালে বলেন, ‘গোহত্যা বন্ধ করতে আইন প্রণয়নের কোনো দাবি উত্থাপন করতে পারি না। কারণ মুসলমান, বৌদ্ধ, পার্সি ও খ্রিষ্টানরা এ দেশে বাস করে। হিন্দু জনগোষ্ঠী গরু জবাই করবে না, ঠিক আছে। কিন্তু অন্য জাতিগোষ্ঠীকে গরু জবাই করতে কেউ বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। ভারত কেবল হিন্দুদের দেশ; এটা ভাবার সুযোগ নেই। ভারতে যারা বাস করে তার সবাই ভারতীয়। বহুত্ববাদ ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য। আমি মুসলমানদের গোহত্যা না করার জন্য বোঝাতে পারি। ইসলাম ধর্মে গোমাংস খেতেই হবে; এমন ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু আইন করে বন্ধ করা যাবে না (Hind Swaraj, Collected Works of Mahatma Gandhi HYPERLINK “http://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/mahatma-gandhi-collected-works-volume-10pdf”i., 11 December, 1909.)|।

হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর কাছে গরু বিশেষ করে গাভী দেবতাতুল্য ও পূজনীয়। বৈদিক যুগ থেকে গরুর প্রতি মমত্ববোধ প্রদর্শনের প্রবণতা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে খুব লক্ষণীয়। এর পেছনে দর্শন হলো- গরু দুধ দেয়, গরু দিয়ে হালচাষ করা হয়, গোমূত্র ও গোবর পবিত্র এবং সুচিতার প্রতীক। জন্মদাত্রী মাতা আসল মা, সবশিশু মায়ের দুধপান করে। কেউ মায়ের মাংস খায় না। মানুষ যেহেতু গরুর দুধপান করে, তাই গরু হলো ‘গোমাতা’। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃষি ব্যবস্থার বিস্তার আর ক্রমবর্ধমান গবাদিপশুর প্রয়োজন গরুকে ক্রমে সম্মানের আসনে বসিয়েছে, তাকে মায়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাই শাস্ত্র অনুযায়ী, ‘গরু’ মনুষ্য জাতির মঙ্গল করছে, সুতরাং, ভগবান তার মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন, এমনটা হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস। তার ধর্মগ্রন্থ বেদে বলা হয়েছে- মাতা রুদ্রানাং দুহিতা বসূনাং স্বসাদিত্যানামমৃতস্য নাভিঃ।

প্রনু বোচং চিকিতুষে জনয়া, মা গামনাগা
মদিতিং বধিষ্ট ( ঋগে¦দ- ৮/১০১/১৫ );
যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পুরুষম।
তং ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসো
অবীরহা (অথর্ববেদ- ১/১৬/৪ )
অনুবাদ : ‘তুমি যদি আমাদের গরু, অশ্ব ও প্রজাদিগকে হিংসা করো বা হত্যা করো, তবে তোমাকে সীসা দ্বারা বিদ্ধ করিব যাতে আমাদের মধ্যে বীরদের বিনাশক কেহ না থাকে। এই গাভী রুদ্রগণের মাতা, বসুগণের কন্যা, আদিত্যগণের ভগিনী অমৃতস্বরূপ দুধের আবাসস্থান। তাই আমি জ্ঞানবানকে বলছি যে, তোমরা নিরপরাধ গো-জাতিকে হত্যা করো না।’

হিন্দুদের অবতার শ্রীচৈতন্য বলেন-
‘প্রভু কহে, বেদে কহে গোবধ নিষেধ।
অতএব, হিন্দুমাত্র না করে গোবধ।
গো অঙ্গে যত লোম তত সহস্র বৎসর।
গোবধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।’
(চৈঃ চঃ আদি ১৭/১৫৯/১৬৬)
অনুবাদ : ‘বেদে গোবধ (গরুহত্যা) নিষেধ। তাই হিন্দুরা কখনই গোবধ করে না। যে ব্যক্তি গো বা গাভী হত্যা করবে, সেই গরুর শরীরে যত লোম আছে তত হাজার বছর গোবধী ‘রৌরব’ নরকে যন্ত্রণার সাথে পচতে থাকবে।’

এক শ্রেণীর শাস্ত্রবিদের মতে হিন্দুধর্মে গোহত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, পাপের অন্তর্ভুক্ত। আর যেখানে গোহত্যাই নিষিদ্ধ সেখানে তো গোমাংস ভক্ষণের প্রশ্নই ওঠে না। অপর দিকে আরেক শ্রেণীর শাস্ত্রবিদরা মনে করেন, গোমাংস খেতে হিন্দুধর্মে বাধা নেই। এই সনাতন ধর্মের সুপ্রাচীন বিশ্বস্ত ধর্মগ্রন্থ বিষ্ণু পুরাণ। এর ১৬তম অধ্যায়ে কোনো হিন্দু ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার বংশধর কর্তৃক কোন খাদ্য দ্বারা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে আগত ব্রাহ্মণ বা অতিথিদের আপ্যায়ন করা হলে মৃতব্যক্তির আত্মা পরিতৃপ্ত থাকবে, তার একটি তালিকা দেয়া আছে। মাছ দিয়ে আপ্যায়নের করালে দু’মাস, পক্ষিমাংস প্রদানে চার মাস, শূকর মাংস প্রদানে পাঁচ মাস, ছাগ মাংস প্রদানে ছয় মাস, ত্রণ (মৃগবিশেষ) মাংস দিলে সাত মাস, হরিণ মাংস প্রদান করলে আট মাস, গবয়মাংস প্রদানে নয় মাস, মেষমাংস প্রদানে দশ মাস এবং গোমাংস প্রদান করলে এগার মাস পর্যন্ত পিতৃগণ পরিতৃপ্ত থাকেন (শ্রী মহর্ষি বেদব্যাস প্রণীত বিষ্ণু পুরাণ, আচার্য পঞ্চানন তর্করতœ সম্পাদিত, প্রকাশক নবভারত পাবলিশার্স, ৭২ মহাত্মা গান্ধী রোড, কলিকাতা, ভারত; ১৩৯০ বাংলা; মুহাম্মদ আবদুস সালাম প্রধান, দৈনিক সংগ্রাম, ঢাকা, ১০ জুলাই, ২০১৭)।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গরুর পূজা করা হয়। বহু মন্দিরের দেয়ালগাত্রে ও প্রধান ফটকে গরুর ভাস্কর্য দেখা যায়। রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশ চন্দ্র শর্মা ২০১৭ সালে এক রায়ে উল্লেখ করেন যে, ‘৩৩ কোটি দেব-দেবী গরুর অভ্যন্তরে বাস করে। গরু একমাত্র জীবন্ত প্রাণী যে অক্সিজেন গ্রহণ করে আবার অক্সিজেন নিষ্ক্রমণ করে। গোমূত্র পান বিগত জীবনের পাপ মোচন করে দেয়’ (After asking the Centre to declare cow as the national Animal, the Rajasthan High Court said, “It is believed that 33 crore gods and goddesses reside inside the cow.” “Cow is the only living being which intakes oxygen and emits oxygen… Drinking cow urine rids one of the sins of the previous life,” HC judge Mahesh Chandra Sharma said. (The Hindustan Times, 31 May 2017)|

মথুরা, বৃন্দাবনসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় মন্দিরের অধীনে বিশাল চারণভূমি রয়েছে। কসাইর কাছ থেকে গরু কিনে চারণভূমিতে ছেড়ে দেয়া হয়। এখানেই এক সময় তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। বহু ধর্মপরায়ণ হিন্দু গরু কিনে রশি উন্মুক্ত (উৎসর্গ) করে দেন। তাদের কোনো মালিকানা নেই। যত্রতত্র গরুগুলো খায় এবং ঘুরে বেড়ায়। অনেক সময় ক্ষেতের ফসল সাবাড় করে ফেলে। খাবারের দোকানে ঢুকে রুটি ও পরোটা মুখে তুলে নেয়। পশুপালন দফতরের পরিসংখ্যান মতে, ভারতে ২০১২ সালে ৫০ লাখ বেওয়ারিশ গরুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব গরু সড়ক দুর্ঘটনা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। উত্তর প্রদেশে ট্রেনে কাটা পড়ে সাত হাজার গরু মারা যায়। পশ্চিমবঙ্গে রাস্তায় চলাচলকারী বেওয়ারিশ গরু সরকারিভাবে আটক করা হয়।

গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মির, হরিয়ানা রাজ্যে গরু জবাই ও গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ। এ আইন অমান্য করলে সাত বছর জেল ও ১০ হাজার রুপি জরিমানা। অপর দিকে পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে গো-হত্য বা গোমাংস ভক্ষণের ওপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। কেরালা রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে গরুর মাংস খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করে থাকেন। সেখানে কোনো দিনই গরুর মাংস ভক্ষণ ধর্মীয় অপরাধ হিসাবে বিবেচিত নয়। গো-মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার বিষয়টি ভারতে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেন, অনেকে পাঁঠা খায়, আমি পাঁঠার মাংস খাই না। আমাদের খাবারের তালিকায় কী থাকবে, সেটা আমাদের রুচির ব্যাপার। সেটা কি সরকার ঠিক করে দেবে?

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে গরু পবিত্র ও দেবতাতুল্য। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মুসলমান, খ্রিষ্টান, পার্সি, ইহুদি ও প্রকৃতিবাদীদের কাছে গোমাংস বেশ উপাদেয় খাবার।

‘রেডমিট’ নামে পরিচিত গরুর মাংস অতি পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি খাবার; প্রাণিজ আমিষের একটি ভালো উৎস।

আবহমানকাল ধরে রসনাতৃপ্তিতে গরুর মাংসের কদর স্বীকৃত। বর্তমান সময়ে গরুর মাংস খাওয়ার ব্যাপারে ভীতি কাজ করে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা অজ্ঞতা আর কিছুটা ইচ্ছাকৃত ভূমিকা রয়েছে। রেস্তোরাঁয় ‘নো বিফ’ লিখে ‘মডার্ন’ সাজার প্রবণতাও বেশ লক্ষণীয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গরুর মাংসের উপকারিতাগুলো মানুষের অজানা। এর সঠিক পরিমাণ গ্রহণে মানবদেহের অনেক উপকার হয়। তবে বেশি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য কখনোই ভালো নয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে- গরুর মাংস Conjugated Linoleic Acid (CLA) যা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। উচ্চমান সম্পন্ন প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজের ভরপুর উৎস হলো গরুর মাংস। গরুর মাংসে অনেক রকম ভিটামিন থাকে, বিশেষ করে বি১২ বি৬ রিবোফ্ল্যাবিন ও বি১২-এর প্রয়োজনীয়তা অনেক, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায়ও এর প্রয়োজনীয়তা অনেক। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের মতে, দৈনিক ২.৪ মিলিগ্রাম বি১২ লাগে। তিন আউন্স গরুর মাংস বি১২-এর দৈনিক ৩৭% চাহিদা পূরণ করতে পারে। তিন আউন্স গরুর মাংস ফসফরাস, ভিটামিন বি১২, প্রোটিন, জিংক ও সেলেনিয়ামের খুবই ভালো উৎস। তিন আউন্স কচি গরুর মাংসে আয়রন, নায়াসিন, বি৬ ও রিবোফ্ল্যাভিন পাওয়া যায় (ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ সার্ভিস, ২০০২)।

২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে অনেক এলাকায় বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে ‘গোরক্ষা কমিটি’ গঠিত হয়েছে। গরুকে কেন্দ্র করে হিন্দু জনতার হাতে মুসলিম নাগরিকের হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ক্রমে এ ধরনের জাতিগত বিদ্বেষের ঘটনা বৃদ্ধি পেতে চলেছে। গোরক্ষা আন্দোলনকারীরা অনেক সময় গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করে দেখে, ভেতরে গরুর মাংস আছে কি না। যারা গরুর মাংস খায়, তারা আদতে হিন্দু ধর্মের শত্রু এমন এক বিকৃত ও বিদ্বেষী ধারণা ক্রমেই জোরদার করে তোলা হচ্ছে ভারতে বিভিন্ন অংশে।

২০১৫ সালে রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে, উত্তর প্রদেশের দাদরি গ্রামে মোহাম্মদ আখলাকুর রহমান (৫০) নামে এক মুসলমানের বাড়িতে গরুর মাংস রান্না করা হয়েছে মর্মে একদল গোরক্ষক অভিযোগ তোলে। লাঠি, কিরিচ, চাপাতি ও পিস্তল নিয়ে আখলাকের বাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাতের বেলা। একটি খামারের কর্মী হিসেবে কাজ করতেন আখলাক। তার পরিবার বারবার বলেছে, ফ্রিজে তারা ছাগলের মাংস রেখেছিল, গরুর নয়। উগ্রবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোরক্ষকরা এ কথা শুনতে চায়নি। পিটিয়ে ও পাথর ছুড়ে তাকে হত্যা করে। পুলিশ ওই মাংস জব্দ করে পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক বিভাগে পাঠিয়ে দেয়। ফরেনসিক রিপোর্টে দেখা যায় যে, ওই মাংস ছিল ছাগলের (বিবিসি, ১ অক্টোবর,২০১৫)। যদি প্রমাণিত হতো গরুর মাংস, তা হলে কি একজন মানুষকে পিটিয়ে মারা বৈধতা পেয়ে যেত? স্রেফ সে গরুর মাংস খাচ্ছিল বলে! তা হলে কোথায় আইনের শাসন? কোথায় বহুত্ববাদী সমাজের সংস্কৃতি?

কয়েক দিন আগে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে জনৈক আলিমুদ্দিন তার গাড়িতে করে কিছু গোশত ক্রয় করে বাড়ি ফেরার পথে গোরক্ষা কমিটির সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হন। তারা তার গাড়িটি ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেয় এবং ৫৫ বছর বয়সী আলিমুদ্দিনকে পুড়িয়ে মারে। এরপর দেশজুড়েই গোহত্যা নিষিদ্ধ করার সরকারি ফরমান ওই উগ্রবাদী অপশক্তিকে আরো উৎসাহিত করেছে। ঈদের বাজার করে ট্রেনযোগে বাড়ি ফিরছিল ১৬ বছরের কিশোর মুহাম্মদ জুনায়েদ, ভাই এবং পরিবারের লোকদের সাথে। প্রথমে তাদের ‘গোখাদক’ এবং ‘দেশদ্রোহী’ বলে গালি-গালাজ করা হয়। তারপর শুরু হয় নির্দয় মারধর। একসময় ছুরি দিয়ে কোপানো হয় জুনায়েদকে, ফেলে দেয়া হয় উত্তর ভারতে ফরিদাবাদের চলন্ত ট্রেন থেকে। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় ঝাড়খণ্ড রাজ্যে এক মুসলিম মাংস ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করার দায়ে ২০১৮ সালে আদালত ১১ জন গোরক্ষককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।

এই জাতীয় ঘটনায় ভারতের নাগরিক সমাজ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে নেমে আসে রাজপথে। এত দিন নানা পর্যায়ে বিশেষভাবে সোস্যাল মিডিয়া, টিভি ও সংবাদপত্রে প্রতিবাদ চলে আসছিল। গরু রক্ষার নামে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে ভারতজুড়ে বিক্ষোভের একদিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মন্তব্য করেন, ‘গরুভক্তির নামে মানুষ হত্যা মেনে নেয়া যায় না। নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার কারো নেই।’ আপাতদৃষ্টিতে কঠোর এই মন্তব্যকে লোক দেখানো বলে আখ্যায়িত করেছে দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বামপন্থীরা। বামদল সিপিআইয়ের জেনারেল সেক্রেটারি এস সুধাকর রেড্ডি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। তাতে মোদির বক্তব্যকে স্বাগত জানালেও কার্যকর পদক্ষেপের প্রত্যাশা করে লিখেছেন, ‘আমার মনে হয় এই নিয়ে চতুর্থবার বিষয়টি নিয়ে আপনি কথা বললেন। কিন্তু অতীতে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ২০১৬ সালে ২৮টি গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গণপিটুনিতে নিহতদের মধ্যে ২৪ জনই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের। আজ পর্যন্ত কোনো হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে কারো শাস্তি কার্যকর হয়নি।’

গোমাংস বা গোহত্যা ইস্যুটি যতটা ধর্মীয়, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। যে গরুর মাংসের জন্য এত মারামারি, হানাহানি ও রক্তক্ষয় সে গরুর মাংস রফতানিতে বিশ্বে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয় নম্বরে! জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা, খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক সমীক্ষায় এ কথা বলা হয়েছে। গরুর মাংস রফতানি করে এমন কি কোটি কোটি টাকা আয় করে এই দেশ। পৃথিবীতে যত গরুর মাংস রফতানি হয়, তার ১৬ শতাংশই ভারত থেকে রফতানি করা হয়। ২০১৯ সালে সেই রফতানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টনে। এ দিক দিয়ে ব্রাজিল প্রথম ও অস্ট্রেলিয়া তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ভারতে ছয়টি বৃহত্তম গরুর মাংস রফতানিকারক সংস্থাগুলোর মধ্যে চারটির মালিক হিন্দু ব্রাহ্মণগোত্রীয়। সর্ববৃহৎ কোম্পানির মালিক ইন্দিরা নুয়ি প্রধানমন্ত্রী মোদির ঘনিষ্ঠ যিনি একজন তামিল ব্রাহ্মণ। তাকে অনেকবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে দেখা গিয়েছিল। গোমাংসের ব্যবসার মুনাফা ব্রাহ্মণগোত্র পেলেও গোমাংস ও গোহত্যা নিয়ে ৯০ শতাংশ মুসলমান ও দলিতদের দায়ী করা হয় এবং সেই অজুহাতে হত্যা করা হয়।

কর্নাটকের বিজেপি সরকার গোহত্যা রোধে আইন করার পর কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা সিদ্ধারামাইয়া সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক ও স্বৈরাচারী পন্থায় ওই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। আমি চাই, গরুর মাংসের রফতানি বন্ধ হোক। আর এই বিষয়ে দেশজুড়ে একটিই মাত্র আইন করা হোক। কিন্তু আপনারা যদি খতিয়ে দেখেন তাহলে লক্ষ করবেন যারা গরুর মাংসের রফতানির কাজে যুক্ত রয়েছে তারা বেশির ভাগই বিজেপি সমর্থক। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই গোমাংসের রফতানি বেড়েছে। পুরনো বছরগুলোর পরিসংখ্যান দেখলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। ২০১৩ সালে যেখানে ভারত থেকে ১০ লাখ ৭৬ হাজার টন গরুর মাংস রফতানি করা হয়েছিল, ২০১৫ সালে তা ১৪.৭৫ লাখ টনে পৌঁছায়। এর পরের তিন বছরও ১৩ লাখ টন করে রফতানি করা হয়েছে’ (আজকাল, কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর, ২০২০)।

কম দামে ভালো মাংসের সুবাদে গোটা এশিয়াতে ভারতীয় গরুর মাংসের চাহিদা শীর্ষে। সরকারের অন্যতম উদ্যোগ হচ্ছে যে, চীনে গোমাংস রফতানি পুনরায় শুরু করা।

রফতানির পশুদের পা ও মুখের বিশেষ রোগের চিকিৎসার জন্য ১৩ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিগত দিনে এই রোগের জন্যই চীন ভারত থেকে গোমাংস আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমানে এই রোগের কারণে মাংস রফতানিতে পিছিয়ে পড়েছে ইউরোপ। ভারতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম বড় উৎস গরুর মাংস ও গরুর চামড়া রফতানি। পশু চিকিৎসকদের মতে, শিগগিরই তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশকে এ রোগমুক্ত অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হবে (একুশে জার্নাল, মার্চ ০৩, ২০২০)।

নাগরিক সমাজ মনে করে, উগ্র হিন্দুত্ববাদনির্ভর রাজনীতি ও চানক্যকৌশল ভারতের হাজার বছরের বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থার অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]