রাজনীতির সংস্কৃতিতে নীতি কই

  • জাকির আবু জাফর
  •  ২১ জুলাই ২০২৩, ২০:১২

আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম কী? সবাই বলবেন এ আর কঠিন কি প্রশ্ন! ঠিক, প্রশ্নটি মোটেই কঠিন নয়। জবাবটিও পানির মতো সহজ। জবাব হলো, রাজনীতি! অর্থাৎ আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাটির নাম রাজনীতি।

রাজনীতির কালো থাবা আমাদের ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র সর্বত্র বিস্তৃত। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে রেষারেষির ভয়াবহতা রাজনীতির কারণেই। এর কারণেই পারস্পরিক বিদ্বেষ বিসংবাদ! পরিবার পরিবারে কলহের অন্যতম কারণও এটি। এর জন্যই অভাব সামাজিক নিরাপত্তার। নিত্যপণ্যের গায়ে আগুন কিংবা অনিয়ম নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে এই রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে।

হয়তো কেউ প্রশ্ন তুলবেন- আরে রাজনীতি আবার সমস্যা কী? যার যার পার্টি তার তার। যার যে দল পছন্দ তিনি সে দল করবেন বা সমর্থন করবেন, সে দলের জন্য কাজ করবেন, সে দলের আদর্শ প্রচার করবেন। এটিই তো সরল কথা!
হ্যাঁ কথাটি সরল বটে। কিন্তু যে যার ইচ্ছে মতো দল করা কি সহজ! পছন্দের দলীয় আদর্শ প্রচার করা কি সহজ! কিংবা মনের মতো করে দলীয় কাজ করা কি কোনোভাবে সহজ!
রাজনীতি শব্দটি ভাঙলে কি দাঁড়ায়? আমরা ভেঙে দেখি- রাজ+নীতি। এর অর্থ দাঁড়ায়- রাজার নীতি। অর্থাৎ যে নীতি রাজা মান্য করেন বা যে নীতিতে রাজা চলেন তা-ই রাজনীতি।

কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতির নামে কি দেখছি আমরা? আমাদের রাজনীতি কি রাজার নীতি হিসেবে বেঁচে আছে? নাকি রাজত্ব দখলের নীতিই আমাদের রাজনীতি হয়ে উঠেছে!
রাজনীতিতে ‘নীতি’ শব্দটি অতি গুরুত্বপূর্ণ! বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই নীতি শব্দটিই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। অথবা নীতি হেরে গেছে আমাদের কাছে। কিংবা আমরা হারিয়ে দিয়েছি নীতিকে। সমর্থক, কর্মীদের কথা বাদই দিলাম, নেতাদের কথাই ধরি- ক’জন নেতা রাজনীতির এই ‘নীতি’ মান্য করেন! ছোট থেকে বড় নেতা- বড় থেকে অতি বড় মহান নেতা ক’জন ধার ধারেন নীতির! না, ধার ধারেন না। দরকারও মনে করেন না। ভাবেন, রাজনীতি তো রাজনীতিই! চর দখলের মতো এখানেও দখলদারির খেলা। এখানে নীতির কাজ কি!
সুতরাং এখন রাজনীতি মানে নীতি বিসর্জনের নীতি। রাজনীতি এখন খল-নীতি। রাজনীতি হলো ঠগ-নীতি লুট-নীতি ঘুষ-নীতি পীড়ন-নীতি দমন-নীতি ও পেশি-নীতির রমরমা।

কেউ কেউ অবশ্য বলেন, আরে রাজনীতিতে এত নীতি নীতি করলে চলে! এত নীতি মান্য করে রাজনীতি হয় নাকি! তাদের মতে, রাজনীতি হলো- যে যাকে পারে ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার নাম। না, বুদ্ধির জোরে নয়। পেশির জোরে। আদর্শের জোরে নয়, শক্তির জোরে, ক্ষমতার জোরে যে যাকে পিছনে ফেলতে পারে! আর যদি তেমন শক্তির জোর থাকে তবে পিষে ফেলার চেষ্টা করাই রাজনীতি।
জোর যার তখত তার এই নীতিই এখন প্রবল। ঠেললেও যদি না সরে তবে গলা ধাক্কা দাও। তাতেও কাজ না সারলে নাও আরো আরো কোনো পদক্ষেপ। পেশির জোর এখন রাজনীতির বড় আদর্শ!
এর ফল কি দাঁড়িয়েছে? দাঁড়িয়েছে এই যে, রাজনীতির কোনো নীতি নেই। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নীতিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিয়েছেন। অ-নীতিই এখন নীতি। দুর্নীতিই এখন বড় নীতি! দখল নীতিই এখন আসল নীতি!
মহাবিস্ময়ের বিষয় হলো, আমাদের বেশির ভাগ রাজনীতিক অবলীলায় মিথ্যা বলেন। মাঝে মাঝে সত্যও বলেন না তা নয়। বলেন। তবে মিথ্যার বাজার এতই জমজমাট, সত্যের আওয়াজ আর শোনাই যায় না।

আবার কেউ কেউ সত্য বলাই ছেড়ে দেন। কিংবা মানুষকে সত্য বলতে হয়- এ শিক্ষাই ভুলে যান। মিথ্যা মানুষের গুণ নয়, এ কথাই মানতে নারাজ! তিনি বা তারা মিথ্যার অলঙ্কারে সাজিয়ে তোলেন নিজেকে। দলকেও। ফলে নেতা যা বলেন তা-ই বুলি হয়ে ওঠে কর্মীদের।
এদের কেউ কেউ মিথ্যায় এতটাই পারদর্শী, এরা সত্যের চেয়েও মিথ্যায় সাবলীল! আবার কেউ কেউ মিথ্যাকেই সত্যি হিসেবে প্রতিষ্ঠার কাজ করেন হরদম। আবার কারো নিদারুণ তামান্না হলো- তার মিত্যেটাই গ্রহণ করুক দুনিয়াবাসী।

তাহলে ইনি বা এরা মানুষ হলেন কী করে? এ জিজ্ঞাসা কি অমূলক! সত্যিই তো, মানুষ কোথায়! কি করে মানুষ! যার মধ্যে ‘মান’ এবং ‘হুঁশ’ আছে সেই তো মানুষ। মান নেই তো মানুষ কি করে! হুঁশ নেই তো মানুষ কি করে হয়। তো যিনি কেবল নীতি বিসর্জন দিয়েই চলেন, যিনি কেবলই মিথ্যা বলেন, যিনি অন্যকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন এবং যিনি মানুষকে মানুষই মনে করেন না, তিনি কি মানুষ!
তার বা তাদের নীতি কি করে রাজনীতি হবে বলুন! কবি আল মাহমুদ-এর একটি কবিতার ক’টি লাইন এমন-
মানুষ মানুষ করে যারা মানুষ তারা কে/অফিস বাড়ির মধ্যে রোবট কলম ধরেছে। /নরম গদি কুশন আসন চশমা পরা চোখ/লোক ঠকানো হিসাব লেখে কম্পিউটারে শ্লোক। / বাংলাদেশের কপাল পোড়ে ঘূর্ণি ঝড়ে চর/মানুষ গড়ার শাসন দেখে বুক কাঁপে থরথর!/ হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস গান শোনোনি ভাই/মানুষ হবার ইচ্ছে আমার এক্কেবারে নাই।

হ্যাঁ, এমন মানুষ কেন হতে হবে! যে মানুষ মানুষ ঠাকায়! যে মানুষ মানুষের সুখ নষ্ট করে! যে মানুষ মানুষের নিরাপত্তা ধ্বংস করে এবং যে মানুষ মানুষের ভয়ের উৎস! তেমন মানুষ হওয়ার কারণ তো দেখি না।
এই তো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি! কিন্তু কেন এ সংস্কৃতি? এমনটি হওয়ার কথা তো ছিল না। এমনটি ছিল কি আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার! তাহলে কি হওয়ার কথা? কি সংস্কৃতি হওয়ার কথা?
হওয়ার ছিল, কথা ও কাজের এক রূপ। যা বলবে তা-ই করবে। নৈতিক দৃষ্টি থাকবে সকল কাজে। ইনসাফ থাকবে, ন্যায়বিচার থাকবে, পেশিশক্তি ঠেকিয়ে দেবে। অবৈধ পথে ক্ষমতা দখলের লালসা দূরে রাখবে। জনসেবা হবে রাজনীতির লক্ষ্য। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। থাকবে ভোট দেবার অধিকার। যে যার রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার করবে। স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করবে। ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। কেউ কারো কাজে বাধা হবে না। আইন হাতে তুলে নেবে না কেউ। অন্যায়কারীর বিচার হবে। সীমালঙ্ঘনকারীকে বাধ্য করবে সীমার ভেতর থাকতে।

একটি দলের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হবেন সবচেয়ে ব্যক্তিত্ববান। তার রুচিবোধ হবে উন্নত। তার দৃষ্টি হবে দূরদৃষ্টি। তিনি বলবেন কম। শুনবেন বেশি। যা বলবেন তা-ই হবে অনুসরণীয়। যা করবেন তা হবে অনুকরণীয়। তার অবস্থান পরিবেশকে আলোকিত করে তুলবে। উন্নত আদর্শ হবে তার ধ্যানজ্ঞান। জনকল্যাণে খরচ হবে তার সময়। এই তো হওয়ার কথা রাজনীতির সংস্কৃতি! অথচ আমরা রাজনীতির ‘নীতি’ হারিয়ে ক্ষমতা-নীতির লোভে দুরন্ত।

লেখক : কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক