- ড. মাহবুব হাসান
- ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আদায়ে যুগপৎ আন্দোলন ও নির্বাচনোত্তর জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রসংস্কার ও রূপান্তরমূলক কর্মসূচির রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত ওই রূপরেখা ও রোডম্যাপ নিয়ে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই রাজনীতির ময়দানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে বিএনপি। এ রূপরেখা প্রণয়নের পেছনে গত ৫০ বছরের শাসনের পটভ‚মি নিহিত রয়েছে।
প্রজাতন্ত্রের জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনী কেবল বিরোধী রাজনীতিকদেরই আইন ভঙ্গের অপরাধ দেখে। সরকারি দলের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের অপরাধ, অন্যায় ও অপকর্ম দেখে না। এই যে গণবিরোধী আচরণ পুলিশের, তারই ফল হচ্ছে পুলিশের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ।
অথচ সরকার বিরোধীদের ওপর লাঠিচার্জ বা তাদের নির্মমভাবে দমনের জন্য, দলিত-মথিত করতে পুলিশকে ব্যবহার করছে। সরকারের এ ধরনের রাজনৈতিক ইচ্ছা পূরণে পুলিশকে ব্যবহার না করতেই বলেছে বিরোধীরা। পুলিশকে বরং প্রতিপক্ষ করে তুলেছে সরকার, নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। দ্বিতীয়ত, তাদের ওপরও যখন পুলিশি নির্যাতন চলেছে, তখন তারাও একই অভিযোগ করেছে। সেই সরকারও তো পুলিশকে নিজেদের স্বার্থেই ব্যবহার করেছে। পুলিশকে ব্যবহারের এই রাজনৈতিক ‘অনৈতিকতা’ কি পরিহার করার সময় আসেনি? সেই ঔপনিবেশিক পুলিশি লিগেসি বহন করতে হবে? সেই ১৮৬২-৬৩ সালে গঠিত পুলিশকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে শাদা চামড়ার লুটেরা ব্রিটিশদের ব্যক্তিগত ও আইনিভাবে রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। আজো সেই ধারাই অব্যাহত। কেন এই পরিত্যক্ত লিগেসি বহন করব আমরা?
এ কারণেই কি রাষ্ট্র সংস্কারের কথা উঠেছে? আমরা বহুবারই বলেছি, কেন স্বাধীন দেশের প্রশাসন ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভেতরে ঢোকানো হলো? আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য তো ওই প্রশাসনের বিরোধী ছিল। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করতে হলে ওই প্রশাসনই তো প্রধান বাধা। সেই বাধা অপসারণের পদক্ষেপই কি রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কারের পরিকল্পনায় স্থান দিয়েছে বিএনপি তার রূপরেখায়? আগামী নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট পেতে অবশ্যই ওই সংস্কার ইস্যুটি একটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হবে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক রংপুরের সংসদ সদস্য মশিউর রহমান রাঙাকে সংগঠনবিরোধী অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কারই কেবল করা হয়নি, রাজনৈতিকভাবে পরিত্যক্ত হয়েছেন তিনি। ওই ঘটনার বিপরীতে রাঙা সাহেব নিজে সংবাদ সম্মেলন করে পার্টির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, টাকার কাছে নতিস্বীকার করে পার্টিপ্রধান তাকে দল থেকে বের করে দিয়েছেন। এই অভিযোগ সত্য কি মিথ্যা, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এটিই বাংলাদেশের রাজনীতির আসল চেহারা। জাতীয় পার্টি এখন রাষ্ট্রসংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আসন্ন প্লাটফর্মে যোগ দিয়েছে। এই সংযুক্তি সরকারকে চমকে দিয়েছে। কারণ, জাতীয় পার্টি সরকারের রাজনৈতিক জোটে ছিল বহু বছর। সংসদে তারা প্রধান বিরোধী দল। এই বিভক্তির সূচনাটি হয়েছে পার্টির অভিভাবক খ্যাত সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের জাতীয় সম্মেলন ডাকার কারণ থেকে। তিনি অসুস্থ হয়ে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন। সেই অবস্থা থেকে তিনি দলের জরুরি সম্মেলন ডেকেছেন। কেন তিনি এতটা জেগে উঠলেন? রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের যে ধারা চলছে, এটি হচ্ছে সেই শৈলশিখরের সামান্য মাথা। পার্টিপ্রধান ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ডেপুটি প্রধান জি এম কাদের সংসদে প্রধান বিরোধী নেতা হওয়ার চিঠি দিয়েছেন তার দলের সংসদ সদস্যদের স্বাক্ষর নিয়ে। এটি আরেকটি শৈলশিখরের চূড়া। চিঠি পাওয়ার পর সংসদ নেতার অনুমোদন নিয়ে স্পিকার সেই আবেদন মঞ্জুর করবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই চিঠি অনুমোদিত হয়নি। কেন? কারণ প্রধানমন্ত্রী হয়তো রওশনকে চান, কাদেরকে নয়। কারণ এই যে, জি এম কাদের এখন রূপান্তরের প্লাটফর্মে আছেন। মূলত কৌশল যখন ষড়যন্ত্র হয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, রাজনীতিতে জল ঘোলা হয়ে উঠেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী নেতারা দশ মুখে বলছেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে। এ কথার জবাব একটাই, তাহলো আপনাদের রাজনীতি তো ক্ষমতায় পৌঁছানোর। সেখানে রাজনৈতিক কৌশলকে সরকারের লোকেরা ষড়যন্ত্র বলেই চিত্রিত করেন, যা রাজনীতি নয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতির মননও নয়। জনগণের মন জানতে হলে তাদের সমস্যা-সঙ্কট কী তা জানতে তৃণমূলে যেতে হবে, সেখানেই রাজনৈতিক ক্যাম্প করতে হবে। মিশতে হবে প্রকৃত উৎপাদকের সাথে। সেই সাথে রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী নেতা ও কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে, উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া নেতা-নেত্রীরা অন্যায় করতে দ্বিধা করেন না। কারণ সেখানে কোনো জবাবদিহিতা নেই।