রাজধানীর অধানী কৃষকনেতা নিয়ে আমরা কী করব?
রাজধানী শব্দের সঙ্গে ‘ধান’ শব্দটি আছে। আর ধানের সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক কে না জানে। যেখানেই ধান, সেখানেই কৃষক। রাজধানীর জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। তাই রাজধানীর কৃষক লীগে বেশি ‘ধানী’ নেতা থাকাটাই স্বাভাবিক। বরং আট হাজার নেতার সংখ্যায় আধিক্য নেই, স্বল্পতা আছে—এ রকম একটি যুক্তি খাড়া করতে পারলে মুখরক্ষা হতো। কিন্তু এ নিয়ে রসিকতা যদিবা চলে, তা-ও পানবিড়ির দোকানের বেঞ্চিতে বসে। অভিজাত ক্লাবগুলোতে নৈব চ নৈব চ। কেননা গুলশান বা ধানমন্ডির মতো জায়গায়ই তো এসব নেতার দাপ্তরিক ও আবাসিক অধিষ্ঠান। তাই আলোচিত ক্যাসিনো ক্লাবগুলোতে যাতায়াতকারীদের মধ্যে আপনি ওই ‘ধানী’ নেতাদের দেখা পেলে অবাক হবেন না।
রসিকতা থাক। রাজধানীতে কৃষকের কী কাজ, এটি একটি কান-প্রশ্ন। কান টানলে মাথা আসে। রাজনীতিতে বয়সসীমা বলে কিছু আছে কি না? বয়স্ক ব্যক্তিরা কেন ছাত্রনেতা বা যুবনেতা হন? সরকারি দল বা প্রধান বিরোধী দল, তাদের তো একই চেহারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অকৃষকদের কৃষকনেতা হতে দেখে বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অছাত্রকে ছাত্র বানিয়ে তারপর তো নেতার স্থলাভিষিক্ত করা হলো! তখন কেন তাঁরা অবিচল থাকেন।
এখানে এটা রাজনীতি নয়, অপরাজনীতি। অথচ আমরা অপরাজনীতিকেই রাজনীতি বলছি। পেট্রন-ক্লায়েন্ট ও রেন্ট সিকিং অভিধায় আমরা যে চিত্রটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি, অপরাজনীতি তারই প্রতিচ্ছবি। অকৃষকদের কৃষক নেতা হওয়া তারই প্রতিচ্ছবি। ছাত্রত্ব ও যৌবন পেরিয়ে আসা ব্যক্তির ছাত্রনেতা বা যুবনেতা হয়ে টিকে থাকারই প্রতিচ্ছবি।
আমরা যদি মূল ছবি বদলাতে দেখি, তাহলে বুঝব, শেষের ছবির ফ্রেমগুলো দুলতে শুরু করেছে। অবৈধ ক্যাসিনো, যেখানে জুয়ার চেয়ে বেশি কিছু ঘটেছে, সেখানে আমরা চলমান বাছাই করা অভিযানে অবাক হই, কিন্তু ওই দুলুনিটা টের পাই না। কারণ, মূল ছবিটা অপরিবর্তিত থাকছে।
দেশের একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন, ‘রাজনীতিকে কলুষিত করেছে ক্ষমতার রাজনীতি। এখন তো ক্ষমতা সংহত। প্রচলিত ঝুঁকি নেই। তাই সরকার চাইলেই রেন্ট সিকিং বন্ধ করতে পারে। এখন তার তা করা উচিত। কারণ, সুশাসন ও আইনের শাসনটা দিতে হবে। এটা ছাড়া উন্নয়ন ও জিডিপির যে সুন্দর রূপকল্প, সেটা ধূসর হবে। টিকবে না।’
ওই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, তিনি একদা মনে করতেন, বড় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার চাইলে দুই নেত্রীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জাতীয় সমঝোতা লাগবে। এখন আর তিনি তা মনে করেন না। সংবাদমাধ্যমে, বিশেষ করে জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকীয়তে কিছুদিন পরপরই জাতীয় ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হতো। অনেক দিন হলো, এটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন থেকে ২০০৬ সালে বিএনপির পতনের মধ্যবর্তী সময়ে সমাজ এই অভিপ্রায়কে বাস্তবসম্মত মনে করেছে। যাঁরা বাস্তবসম্মত মনে করেননি, তাঁরাও লিখেছেন। কারণ, মনে করা হয়েছে, এর কোনো বিকল্প নেই। সেই বাস্তবতাটা বাসি হয়ে গেছে। তবে দেখার বিষয় হলো, এখন আমরা সুশাসন চাই। সুআইন চাই। সেই আইনের শাসন চাই। কিন্তু প্রক্রিয়াটা কী, সে নিয়ে আমরা সেভাবে কথা বলি না।
কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের চেয়ারম্যানকে অস্ত্র, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারের পর তাঁকে কৃষক লীগ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার পেশায় ঠিকাদার হলেও কৃষক লীগের সভাপতি স্বপদে বহাল আছেন। এ রকম অসংগতির তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আমরা অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন নিয়ে কথা বলেছি। বিদেশে কেন আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক দলের শাখা-প্রশাখা থাকবে, তারা কেন সেই ব্যানার হাতে ডিম ছুড়বে। কালো পতাকা দেখানোর অনুশীলন করবে, আমরা কখনো এর সদুত্তর পাইনি।
সময়ে সময়ে আমরা কিছু শুদ্ধি অভিযান দেখছি। আবার তা হারিয়েও গেছে। তবে যখনই এমনটা দেখি, তখনই মনে হয়, দুর্নীতির মূল ছায়াছবি বদলানোর রাজনৈতিক উদ্যোগ কি না। খবর পাই না। তবে কিছু শুদ্ধিকরণেও সন্তুষ্ট হতে চাই যদি তা শুধুই কৌশলগত না হয়। কারণ, একচিলতে আলো দিয়ে আরও বড় অনিয়ম চালাতে থাকা ঠিক নয়।
অধ্যাপক আবুল বারাকাতের ভাষ্যমতে, ‘লুণ্ঠন-অপরাধ-সন্ত্রাস-অবৈধ অস্ত্র-পেশিশক্তি-খুন-জখম-রাহাজানি, ভূমি-জলাশয়-বন দখল, বাড়ছে ধর্মব্যবসা, পীর-ফকিরের সংখ্যা, ধর্মের নামে সহিংসতা, অপসংস্কৃতির চর্চা, একই সঙ্গে রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনীতিকে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে রূপান্তরের মাধ্যমে সুবিধাভোগী শ্রেণিই এখন হয়ে উঠেছে সমাজের চালক।’
সুতরাং সমাজের চালকদের সংকট আর গণতন্ত্রের সংকট এক নয়। এই চালকদের ব্যবস্থাপনা সংকট থেকে আসা কর্মসূচি খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারে না। দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রায়ণের দিকে নজর দিতে হবে। আগামী নির্বাচন বহুদূর বাকি। তাই এখনই শুদ্ধিকরণ শুরু হতে পারে। কৃষক লীগের মতো অঙ্গসংগঠন দিয়ে তা শুরু করা ভালো। বিএনপি করবে না বলে আওয়ামী লীগ বসে থাকতে পারে না।
সবচেয়ে ভালো হয় গোল্ডেন হ্যান্ডশেক স্কিমের একটা ঘোষণা দিলে। এটা সম্মানজনক ও কার্যকর হতে পারে। যার যা কাজ নয়, সেই কাজে তার অধিষ্ঠান কিংবা ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা ভোগ করতে দেওয়ার মতো ভয়াবহ দুর্নীতি আর হয় না। এসবই আমাদের নিয়মিত বাহিনীগুলোকে দুর্নীতি দমনে অনেকাংশে অকার্যকর করে রাখে। সমাজের ওপর প্রথমে একটা মোটামুটি স্বচ্ছ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা থাকতে হবে। বর্তমানে এটা নেই। এর ফলে আরও শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেও সমাজে আইন প্রতিষ্ঠায় সুফল মিলবে না।
আগে চাই রাজনৈতিক পুলিশিং। এর মানে রাজনৈতিক নেতারা সমাজে শাশ্বত অনুশাসন প্রতিষ্ঠার দায় নেবেন। আর সে জন্যই কৃষক লীগকে অকৃষকমুক্ত করা দরকার।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।
[email protected]