আর দুই মাস পর রমজান। এর মধ্যেই পাইকারি ও খুচরা বাজারে রমজাননির্ভর নিত্যপণ্য আটা, ময়দা, ডাল, ছোলা, বেসন, ব্রয়লার মুরগি, খেজুর, চিনি, চিড়াসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ছোলা খুচরায় কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা এবং ছোলার ডাল, খেসারির ডাল, মুগ ডাল ও বেসনের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। এ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। ডলার সংকট ও ঋণপত্র খোলা নিয়ে জটিলতাকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। এলসি জটিলতা এখানো পুরোপুরি কাটেনি। অবশ্য বাজারে এসব সংকট কাটাতে এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরবরাহ বাড়াতে আসন্ন রমজান মাসে ৮ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভোজ্য তেল, ছোলা, ডাল, মটর, পিয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরেও দেশে এখনো ডলারের তীব্র সংকট বিদ্যমান। পাশাপাশি রিজার্ভ কমছে অব্যাহতভাবে। ব্যাংকে ডলার সংকট।
ফলে চাহিদামাফিক আমদানি করা যাচ্ছে না। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে পণ্যের মজুতের ওপর। এ কারণে রমজানকে ঘিরে এসব পণ্যের চাহিদা, মজুত ও সম্ভাব্য জোগানের মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, সাধারণত রমজানের দুই থেকে তিন মাস আগে থেকে খুচরা বিক্রেতারা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এখন থেকেই পাইকারি বিক্রেতারা রোজার সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। এতে খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।
ওদিকে মূল্যস্ফীতি কিছুতেই ৯ শতাংশের নিচে নামছে না। মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। আর চার মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি।
দেশের মানুষ যাতে স্বস্তিতে থাকতে পারে সেজন্য নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, রমজান ঘনিয়ে আসছে, তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন, কারণ, এই মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ানো উচিত নয়। গতকাল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এখানে আসা নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। টুঙ্গিপাড়ায় তার নিজ বাসভবনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রাজস্ব আয়-এসব সূচক নিম্নমুখী। পাশাপাশি ডলার সংকট নিয়ে এলসি জটিলতা কাটেনি। ফলে রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ে শঙ্কা আর বাকিতে পণ্য আমদানি করা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।
রপ্তানি: সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে অবশ্য রপ্তানিতে ৯.০৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই সময়ে ৫৩৬ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছে।
রিজার্ভ: গত এক বছরে রিজার্ভ শুধু কমেছে। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসের শেষে আইএমএফ’র বিপিএম-৬ হিসাব পদ্ধতি অনুসারে, রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার কোটি ডলারের নিচে।
ডলার সংকট: বছরের শেষে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ টাকা। যদিও আমদানি পর্যায়ে ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম ১২২-১২৩ টাকা উঠছে। এর ফলে আমদানিকারকদের বাড়তি দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।
রেমিট্যান্স: বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হলো বৈধ পথে আসা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। কিন্তু ডলারের দামের পার্থক্যের কারণে বৈধ পথে ডলার আনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন গতি আনতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, বিদায়ী ২০২৩ সালে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৯০ কোটি ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলার। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলারে জানায়, রমজানের আগে ৯০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে বাকিতে পণ্য আমদানির সুযোগ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী মার্চ পর্যন্ত সাপ্লায়ার্স ও বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় ভোজ্য তেল, ছোলা, ডাল, মটর, পিয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর আমদানি করা যাবে।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমজানকে ঘিরে গত এক মাসে ছোলার দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক আগেও প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। ছোলার ডাল কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। খুচরায় খেসারির ডাল প্রতি কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগেও ছিল ৯৫ থেকে ১০০ টাকা কেজি। এক মাসের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে মুগ ডালের। কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা দাম বেড়ে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশে বর্তমানে রেকর্ড দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। খোলা চিনি প্রতি কেজি ১৪৫ ও প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ১৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বাজারে জাত ভেদে সব ধরনের খেজুরের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। দাবাস ও তিউনিসিয়ান জাতের মতো সাধারণ মানের খেজুরের কেজি এখন ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আজোয়া খেজুর মানভেদে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মরিয়ম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা কেজি দরে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, প্যাকেটজাত আটা কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬৫ টাকায়। খোলা ও প্যাকেটজাত ময়দা কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা ও ৭০-৭৫ টাকায়। প্রতি কেজি মুগডাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১০০-১৬০ টাকায়। যদিও এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৯৫-১৩৫ টাকায়। ছোলার দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ৯৫-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট দানার মসুর ডাল কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়।
বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দেশি রসুনের দাম ২০ টাকা বেড়ে বর্তমানে মানভেদে ২২০-২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি হওয়া আদার দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ২০০-২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট এলাচের দাম প্রায় ৬০০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০০-৩৬০০ টাকায়।
কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী মাজেদ বলেন, সব ধরনের ডালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আগে মুগডাল ১৪০ টাকায় বিক্রি করতাম। এখন প্রতি কেজির দাম ১৬০ টাকা। আমাদের বেশি দামে কিনে আনতে হয়। এ কারণে বেশি দামে বিক্রি করছি।
এদিকে গমের দাম মণপ্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ (রাশিয়া) টাকায়, কানাডিয়ান গম ২ হাজার টাকায় লেনদেন হচ্ছে।
রমজানের অন্যতম নিত্যপণ্য চিড়ার দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। বর্তমানে মানভেদে প্রতি বস্তা চিড়া ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, রমজানে যেন বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে সেজন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, প্রতি বছরই রমজানের কয়েক মাস আগে থেকেই দাম বাড়ানো শুরু করে। রমজানের সময় তদারকি বেশি থাকে এ কারণে আগেই দাম বাড়িয়ে বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়। এবারো তাই হচ্ছে।