দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ফের ২০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। অক্টোবর শেষে যা ১৯ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার ছিল। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) ১৩৭ কোটি ডলার পরিশোধের পর গত ৯ সেপ্টেম্বর ১৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছিল। এর আগে যা ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ছিল। মূলত রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে উন্নতির ফলে রিজার্ভ বাড়ছে। একই সঙ্গে টাকার বিপরীতে ডলারের দর স্থিতিশীল রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় এখন আর এলসি খুলতে কোনো সমস্যা নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
বাংলাদেশের বর্তমানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় চার মাসের আমদানি দায়ের সমান। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আমদানিতে মোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৫১৯ কোটি ডলার। প্রতি মাসে গড়ে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫০৬ কোটি ডলার। একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি দায় মেটানোর খরচের নিচে নামলে তা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। আর ৬ মাসের বেশি রিজার্ভ থাকলে তা স্বস্তিদায়ক হিসেবে গণ্য করা হয়। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের পাশাপাশি বিভিন্ন উৎস থেকে কম সুদের ঋণের কারণে আগামীতে রিজার্ভ আরও বেড়ে ডলার বিদেশের সঙ্গে লেনদেন ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা হচ্ছে।
রমজান সামনে রেখে গতকাল সচিবালয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য সরবরাহ নিয়ে এক বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, এখন আর ডলারের কোনো সংকট নেই। যে কেউ যে কোনো ব্যাংকে গিয়ে এলসি খুলতে পারবেন। টাকা না পেলেও এখন ব্যাংকে ডলার পাওয়া যাবে। এর পরও কেউ ডলার না পেলে তাঁকে জানালে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। ডলারের সরবরাহ বেশি থাকার কারণেই দর ১২০ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। তবে নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে অর্থ পাচার ব্যাপক বেড়ে যায়। আবার করোনা-পরবর্তী বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতা শুরু হয়। বাড়তি চাহিদা মেটাতে ওই সময় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি শুরু করে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যায়। বিক্রি করেও ডলারের দর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ওই সময়ে ৮৪ টাকা দরের ডলারের দর বাড়তে বাড়তে
চলতি বছরের শুরুর দিকে উঠে যায় ১২৩ থেকে ১২৫ টাকায়।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করছে না। পাচার ঠেকাতে কঠোরতার পাশাপাশি আগে নেওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডলারের দরও ১২০ টাকায় স্থির রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি অনেক কমে চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ঘাটতি ছিল ১৮৩ কোটি ডলার। আর্থিক হিসাবে গত অর্থবছরের তিন মাসের ১২৩ কোটি ডলারের ঘাটতি থেকে এখন ৫৬ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে। বৈদেশিক লেনদেনে সামগ্রিক ঘাটতি ২৮৫ কোটি ডলার থেকে কমে ১৪৬ কোটি ডলারে নেমেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৮ মে ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর মাধ্যমে ডলারের দর প্রায় বাজারভিত্তিক করা হয়। এর পর রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়তে শুরু করে। মে মাসে ২২৫ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। পরের মাসে আরও বেড়ে ২৫৪ কোটি ডলার দেশে আসে। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এক পর্যায়ে আন্দোলন দমাতে তৎকালীন সরকার শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়। তখন সরকারকে অসহযোগিতার জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠাতে ব্যাপক ক্যাম্পেইন শুরু হয়। এতে করে রেমিট্যান্স কমে জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ডলারে নেমে আসে। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবার বাড়ছে। আগস্টে ২২২ কোটি এবং সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ২৪০ কোটি ডলার করে দেশে এসেছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৯৮৪ কোটি ডলার দেশে এসেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ২০৬ কোটি ডলার বা ২৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেশি। আবার চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ৫৮৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাম্প্রতিক কোনো বছর রেমিট্যান্সে এত প্রবৃদ্ধি হয়নি। আবার গত অর্থবছর রপ্তানি প্রায় ৬ শতাংশ কমার পর সাম্প্রতিক বৃদ্ধি ডলার বাজারে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। এর মধ্যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো সংস্থা থেকে কম সুদের ঋণ পাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
samakal