দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। শিকার হচ্ছেন ছাত্রীরা। কখনো কখনো নারী শিক্ষকেরাও ভুক্তভোগী হচ্ছেন।
দেশের শীর্ষ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই বছরে ২৭টি যৌন হয়রানির ঘটনা পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় অভিযোগ জমা পড়েছে যৌন হয়রানিবিষয়ক অভিযোগ জানাতে গঠিত ‘অভিযোগ কমিটি’তে। হাইকোর্টের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই কমিটি গঠন করা হয়। তবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটির কার্যকারিতা কম। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা এই কমিটির কথা জানেনই না।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, অনেক অভিযোগ এই কমিটিতে জমা হয় না। অনেক ঘটনা শিক্ষার্থীরা গোপন রাখেন হয়রানির ভয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানালেও তা গোপন রাখা হয়। ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তবে ঘটনা প্রকাশ্যে এলে সক্রিয় হয় প্রশাসন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পর তা গোপন রাখে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর কার্যালয়। তারা ঘটনাটিতে ব্যবস্থা নেয়নি। ‘হয়রানি ও হুমকি’র মুখে ফাইরুজ ১৫ মার্চ কুমিল্লায় নিজের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন। ঘটনার আগে ফেসবুকে লিখেছেন, তাঁর সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান এর জন্য দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ছেলেটির পক্ষ নিয়ে তাঁর (ফাইরুজ) সঙ্গে বাজে আচরণ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিযোগ কমিটি কী কাজ করে, সে বিষয়ে বারবার তথ্য চেয়েও পায় না বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ কমিটি যে খুব একটা কার্যকর নয়, সেটি ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীরের কথায়ও সামনে এসেছে।
ইউজিসিতে আসার আগে অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর দুই মেয়াদে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবতা হলো, যত ঘটনা ঘটে তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী অভিযোগই দায়ের করেন না। কারণ, ভুক্তভোগীরা ভাবেন অভিযোগ দিলে বিচার না-ও হতে পারে। আবার বিচার হলেও পরে এ নিয়ে বিপদে পড়ার আশঙ্কা আছে। তিনি বলেন, অভিযোগ কমিটি থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশই সক্রিয় নয়।
অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর মনে করেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সচেতনতা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়ার কাঠামোও বদলাতে হবে।
যত অভিযোগ
এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ইউজিসির সূত্র জানিয়েছে, দেশের ৪৫টি পাবলিক ও ৯৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা সেল নামেও পরিচিত। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫, বেসরকারি ১১৪ (কয়েকটি কার্যক্রমে নেই)।
অভিযোগ কমিটিতে যে ২৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২টি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২টি।
ইউজিসির চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেওয়া মানবাধিকার কমিশনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন এক শিক্ষার্থী। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে জানাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। ২১ মার্চ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। ওই শিক্ষককে তদন্তকালে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে গত মাসে। ওই শিক্ষক তিন মাসের ছুটিতে রয়েছেন এবং ঘটনাটির তদন্ত চলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুই বছর ধরে অভিযোগ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক জিনাত হুদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সময়কালে এখন পর্যন্ত তিনটি অভিযোগ এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, তিনটির মধ্যে দুটির তদন্ত শেষ হয়েছে। আরেকটি প্রক্রিয়াধীন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত পাঁচ বছরে পাঁচটি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে দুটি ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর জমা পড়ে। পাঁচটিতেই অভিযুক্তদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি হয়েছে। যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৩১ জানুয়ারি রসায়ন বিভাগের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ করেছিলেন এক ছাত্রী। এ ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় ওই অধ্যাপককে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলে গত দুই বছরে অন্তত ছয়টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে তিনটি অভিযোগের তদন্ত শেষে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। একটি ক্ষেত্রে শাস্তি হয়েছে। দুটি ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াধীন। তিনটি অভিযোগের তদন্ত আর এগোয়নি। কারণ হিসেবে কমিটি জানিয়েছে, অভিযোগকারী ব্যক্তি সহযোগিতা করেননি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২১ মে মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও অশোভন আচরণের অভিযোগ করেন ওই বিভাগের এক নারী শিক্ষক। অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে ওই শিক্ষককে দুই বছর ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় সিন্ডিকেট।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ কমিটির নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১৪টি অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এর মধ্যে ১২টির অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। দুটি অভিযোগ তদন্তাধীন। নিষ্পত্তি হওয়া ঘটনাগুলোতে বিভিন্ন মেয়াদে ও ধরনের শাস্তি হয়েছে। ২০২৩ সালের মে মাসে অর্থনীতি বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এক ছাত্রকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অভিযোগ কমিটিতে জমা পড়া অভিযোগের বাইরে একটি যৌন নিপীড়নের ঘটনায় গত মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের এক শিক্ষককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়।
অভিযোগ জানতে ই-মেইল খোলা, অভিযোগ বাক্স খোলা, অনুষদে প্রচার চালানোসহ নানা উদ্যোগের কথা জানিয়ে কমিটির সভাপতি অধ্যাপক জেবউননেছা প্রথম আলোকে বলেন, সাত সদস্যের কমিটির পক্ষে সবাইকে বিষয়টি জানানো কঠিন। তাই প্রত্যেক শিক্ষকের উচিত শ্রেণিকক্ষে অভিযোগ কমিটির বিষয়ে জানানো।
ফাইরুজের ঘটনার বাইরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিতে দুই বছরের বেশি সময়ে আবেদন এসেছে দুটি। যার একটির তদন্ত প্রতিবেদন বিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছে কমিটি; অন্যটির তদন্ত চলছে।
শীর্ষ পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও যৌন হয়রানির ঘটনা পাওয়া গেছে। যেমন ১৪ মার্চ ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এক শিক্ষককে স্থায়ী বরখাস্ত করা হয়। অবশ্য তা আন্দোলনের মুখে। অভিযোগ পাওয়ার পরও অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আলীম ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে স্নাতকোত্তর ও স্নাতকে অধ্যয়নরত ২০০ ছাত্রীর ওপর একটি জরিপ করেন। ‘বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরুষতান্ত্রিক ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের কৌশল’ শিরোনামের গবেষণায় উঠে আসে, যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ শতাংশ ছাত্রীই অভিযোগ করেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ জমা পড়ার পর অযথা সময়ক্ষেপণ করা হয়। দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত বিদেশে চলে যান অথবা অবসর নিয়ে নেন। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী শিক্ষক সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ঠিকমতো তদন্তই হয় না। কোনো কোনো সময় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সক্রিয় হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যৌন হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে ইউজিসিকে যে ঠিকমতো তথ্য দেয় না, তা উল্লেখ করেন সংস্থাটির উপপরিচালক মৌলি আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছয় মাস পরপর চিঠি দেওয়া হয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তথ্য দেয়। অন্যরা বিশেষ করে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তথ্য দেয় না।
নারীবান্ধব ক্যাম্পাসের ঘাটতি
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করার ঘটনাগুলো এমন সময়ে বেশি ঘটছে, যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যা সমান হতে চলছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি।
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অধিভুক্ত কলেজ-মাদ্রাসাসহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৪৪ লাখ ১৬ হাজার। এর মধ্যে ছাত্রী ৪৮ শতাংশ। সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের অনুপাত প্রায় সমান হলেও সুযোগ-সুবিধার নানা ক্ষেত্রে ছাত্রীরা পিছিয়ে। নারীবান্ধব ক্যাম্পাসের ক্ষেত্রেও ঘাটতি আছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে হলসংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনার পর ইউজিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ক্যাম্পাস নারীবান্ধব করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশানুরূপ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি অথবা গৃহীত পদক্ষেপের কোনো সফলতা আসেনি।
কেন ঘটনা বাড়ছে
বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ কমিটি গঠনের নির্দেশ এসেছিল বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে। সমিতিটির সভাপতি সালমা আলী সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ হলো যৌন হয়রানির ঘটনা যতটা ঘটে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ জমা পড়ে না। এর কারণ, অভিযোগ কমিটি সম্পর্কে সচেতনতার বড় ঘাটতি আছে।
সালমা আলী আরও বলেন, জবাবদিহির অভাব, সময়মতো তদন্ত ও দৃশ্যমান শাস্তি না হওয়া এবং রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার কারণে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো ঘটেই চলছে।
Prothom alo