যে কারণে দুই কূলই গেল রওশন এরশাদের

সরকার ও দলের সমর্থন হারিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ছিটকে গেলেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। জাতীয় পার্টির (জাপা) সূত্রগুলো জানিয়েছে, ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদের কারণে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সমর্থন হারান তিনি। আর নির্বাচনে আনতে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার সঙ্গে সরকারের সমঝোতার কারণে ক্ষমতাসীনদের এবার পাশে পাননি বিরোধীদলীয় নেতা। এতে দুই কূলই হারিয়েছেন জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন।

অসুস্থতা ও বয়সের কারণে রওশন এরশাদ ফের রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন, তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যদিও তাঁর অনুসারীরা বলছেন, ‘খেলা এখনও শেষ হয়নি’। বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ সমকালকে বলেছেন, আগামী দু-একদিনের মধ্যে সভা করে কর্মসূচি ঘোষণা করবেন রওশন এরশাদ।
কী হবে কর্মসূচি, তা খোলাসা করেননি রওশনপন্থিরা।

তবে জাপা সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভরসায় ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। বারবার চেষ্টাতেও সরকারপ্রধানের সাক্ষাৎ না পাওয়ায় রওশনের ক্ষমতা খর্বের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। জি এম কাদের কোনো কারণে নির্বাচন থেকে সরে গেলেও, অতি নাটকীয় কিছু না ঘটলে রওশনের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে না।

গত বুধবার রাতে গুলশানের বাসভবনে অনুসারীদের নিয়ে বৈঠকে পর রওশন এরশাদ ঘোষণা দেন, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু দলের পরীক্ষিত নেতাদের মনোনয়ন না দেওয়ায় আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন না।

রওশনের জন্য ময়মনসিংহ-৪ আসন ফাঁকা রেখে গত সোমবার ২৮৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে জাপা। বাদ পড়েন সাদ এরশাদসহ বিরোধীদলীয় নেতার সব অনুসারী। গতকাল বৃহস্পতিবার জাপার মনোনীত প্রার্থীরা উৎসব করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়া রওশন শিবিরে ছিল হতাশা। এই পরিস্থিতির জন্য সাদ এরশাদকে দায়ী করেছেন জাপার জ্যেষ্ঠ নেতারা। শীর্ষস্থানীয় এক নেতা সমকালকে বলেন, সরকারি সমর্থন পক্ষে থাকায় বিগত দিনগুলোতে জি এম কাদেরকে গণ্য করতেন না রওশনপুত্র। গত শনিবার রাতে রওশনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে অশোভন

আচরণ করেন। একই কারণে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা সাদ এরশাদের প্রতি নাখোশ। সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই নেতারা এবার জি এম কাদেরকে সমর্থন করায় দুর্বল হয়ে পড়েছে রওশন শিবির। অথচ এই নেতাদের সমর্থনে ২০১৯ সালের উপনির্বাচনে জি এম কাদেরের প্রবল আপত্তির পরও রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে লাঙ্গল পেয়েছিলেন সাদ এরশাদ।

রওশনপন্থিদের সূত্রও অশোভন আচরণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে সাদ এরশাদের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। তিনি অবশ্য সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘জি এম কাদের রংপুর-৩ আসন কিডন্যাপ করেছেন। আব্বুর আসন ছাড়ব না।’

জাতীয় পার্টিতে রওশন ও জি এম কাদেরের মধ্যে বিরোধ চলছে দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জামানা থেকেই। এরশাদের মৃত্যুর পর তা বারবার প্রকাশ হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা এবং দলীয় চেয়ারম্যান পদ নিয়ে বারবার বিরোধে জড়িয়েছেন। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে এরশাদের মৃত্যুর মাস দুয়েক পর জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যস্থতায় রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদে মেনে নেন জি এম কাদের। আর তাঁকে দলের চেয়ারম্যান পদে মেনে নেন রওশন।

জি এম কাদের বিএনপির সুরে কথা বলছেন– অভিযোগ করে তাঁকে নেতৃত্ব থেকে সরাতে গত বছরের আগস্টে কাউন্সিল ডাকেন রওশন এরশাদ। এতে সমঝোতা ভেঙে পড়ে। পাল্টা হিসেবে রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলীয় এমপির সমর্থন নিয়ে চিঠি দেন জি এম কাদের। কিন্তু  সরকারের সমর্থনে টিকে যান রওশন। গত জানুয়ারিতে সরকারি মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের মধ্যে ফের সমঝোতা হয়। দলে ঐক্যের কথা বলে যৌথ বিবৃতি দেন রওশন এবং জি এম কাদের।

কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে মাস দুয়েক আগে আবার বিরোধ শুরু হয়। রওশন দলীয় সরকারের অধীনে বিনা শর্তে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। অংশগ্রহণমূলক না হলে নির্বাচনে যেতে অনীহা ছিল জি এম কাদেরের। এ নিয়ে কথার পাল্টাপাল্টিতে দেবর-ভাবির বিরোধ বাড়ে। সূত্রের খবর, জাপা ফের প্রধান বিরোধী দল হবে, তিনিই হবেন একক নেতা, রওশন সরকারের সমর্থন পাবেন না– এসব শর্ত পূরণের আশ্বাস পেয়ে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জি এম কাদের।

তাতেই ক্ষমতাসীনদের ‘গুড বুক’ থেকে ছিটকে পড়েন গত ১০ বছর বিরোধীদলীয় নেতার পদে থেকেও প্রায় সব ইস্যুতে সরকারের সুরে কথা বলা রওশন। গত শনিবার তাঁর সঙ্গে সরকারের মধ্যস্থতায় দেখা করেন জি এম কাদের। কিন্তু সাদ এরশাদের জন্য রংপুর-৩ আসনের দাবিতে অনড় ছিলেন এ বিরোধীদলীয় নেতা। আর কোনো অবস্থাতেই ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না দলের চেয়ারম্যান। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার শর্ত পূরণ করায় এবার ‘সরকারের সমর্থন’ পান জি এম কাদের। এর পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারায়, সে সমর্থন আর পাননি রওশন এরশাদ। যার ফল হিসেবে রওশন ক্ষমতার লড়াইয়ে পেরে ওঠেননি বলে জানিয়েছেন জাপা নেতারা। অবশ্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, জাপায় এখন বিভেদ নেই, সবাই জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।

সমকাল