২০২১-০৭-১০
কারখানায় নিরাপদ শ্রম পরিবেশের প্রশ্নে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সজীব, সেজান ও নসিলা ব্র্যান্ডের খাদ্য উৎপাদনকারী হাসেম ফুডস কারখানা যেন ১৫ বছর আগের ভয়াবহ রাতকে নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে। ৮ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে কারখানাটির নিচ তলায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। সরকারি হিসেবে মোট লাশের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৫২। জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু ৪৯। ধারণা করা হচ্ছে, মৃতদের অনেকেই শিশু। ১৫ বছর আগে ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে কেটিএস গার্মেন্টসেও আগুন লেগেছিল এরকম সন্ধ্যার দিকেই। ওই ঘটনায় ৬৫ জন নিহত হন।
আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার
কেটিএসের কারখানায় আয়তনের তুলনায় কাজ চলত বেশি, ফলে সেখানে চলাচলের জায়গা ছিল সীমিত। জরুরি নির্গমনের জন্য ছিল না পৃথক কোনো সিঁড়িও। ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার ওই আগুন ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট রাত ৯টা অবধি চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। শুরুতে সিঁড়ি ও দড়ি দিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা উদ্ধারচেষ্টা চালায়। তখন লাফিয়ে পড়তে গিয়ে অন্তত ২০ জন আহত হন। আগুন নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ সময় লাগা নিয়ে জনগণ তখন বিক্ষোভ করে।
রূপগঞ্জে সেজান ও সজীব ব্র্যান্ডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বিকেল পাঁচটার দিকে। ৩৭ হাজার বর্গফুটের ভবনে সিঁড়ি ছিল মাত্র দুটি এবং সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই দেখা গেছে যে, সেগুলো ততটা প্রশস্ত নয়। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট কাজ করে। কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ভবনে প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকার কথা জানান তারা। প্রায় ২০ ঘণ্টা বাদে পরদিন দুপুর নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে ভবন থেকে লাশ বের করার উদ্যোগ নেয়া হয়।
কেটিএসের ঘটনায় অগ্নিকাণ্ডে দীর্ঘ সময় লাগার মতো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে হাসেম ফুডসেও। এখানেও প্রথম বেলায় অল্প আগুন থাকতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ১৫ বছর বাদে এই উন্নত প্রযুক্তির যুগে এসে দেখা যায়, এবারেও তারা সেই দড়ি, মই ব্যবহার করেই উদ্ধারচেষ্টা চালাচ্ছেন। সারা রাত চেষ্টা করে সকাল সাতটার দিকে যখন তারা ভবনের সামনের দিকটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছেন, ততক্ষণে এর অন্য পাশে বালুর মাঠের দিকে ভবনের অপর অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। ১২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে মর্মে সংবাদ সম্মেলন করার পরপরই দেখা যায় ভবনের সামনের দিকে একটি অংশে আগুন পুনরায় বেড়ে যাচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্টরা এর যৌক্তিক কারণ তুলে ধরলেও শ্রমিক ও জনগণ অবশ্য এই দীর্ঘসূত্রীতাকে বড় অবহেলা গণ্য করে। পাশেই অন্য একটি কারখানায় কাজ করা মাহবুব এবং অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের স্টোর রুমে কাজ করা আসলাম হোসেন জানান, ফায়ার সার্ভিসের কাজে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সহযোগিতা করেছেন। প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও তারা ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তুলনায় কোনো কোনো কাজ বেশি করেছেন।
তালাবন্দি, জীবন্ত পুড়ে মৃত্যু
কেটিএসের ঘটনায় জানা যায়, আগুন লাগার পর কারখানার প্রধান ফটক আটকে দেয়া হয়। এতে করে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ৬৫ জন শ্রমিক। লাশের এই সংখ্যা নিয়েও চলে ব্যাপক বিতর্ক। সেনা মোতায়েন করে লাশ বের করা হয় শ্রমিকদের অগোচরে। জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজ শিরোনামে লেখে ‘বেসরকারি হিসাবে লাশ উদ্ধার শতাধিক, সরকারি হিসাবে মাত্র ৫২, বহু গুম করার অভিযোগ’। অপর একটি সংবাদের শিরোনামে প্রশ্ন তোলা হয় ‘৫০০ থেকে ৭০০ হয়ে গেল ৫২, নিহতের সংখ্যা আসলে কত?’
হাসেম ফুডসের অগ্নিদগ্ধ কারখানাটির শ্রমিক, ঘটনার দিন আটকা পড়ে উদ্ধার হওয়া শ্রমিক, পার্শ্ববর্তী কারখানার শ্রমিক, এলাকাবাসী সাক্ষ্য দিয়েছেন, নিচ তলায় আগুনের সূত্রপাত হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন উপরে উঠে যায়। এ সময় চতুর্থ তলার ছাদে ওঠার সিঁড়ির মুখের দরজাটি বন্ধ ছিল। অনেকেই অভিযোগ করেন, নিরাপত্তারক্ষীরাই এই দরজাটি আগুন লাগার পর বন্ধ করে দেয়। চতুর্থ তলার আটকা পড়া শ্রমিকরা ব্যতিরেকে বাকিরা অধিকাংশই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।
শ্রম আইন ২০০৬-এ কারখানা চলাকালে বহির্গমনের পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা রাখা বা দরজা বন্ধ রাখা যাবে না মর্মে সরাসরি নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তাজরিন থেকে কেটিএস হয়ে হাসেম ফুডস- আগুন লাগলে তালাবন্দি অবস্থায় শ্রমিকের মৃত্যু বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে চলেছে ধারাবাহিক।
জনগণের বিক্ষোভে প্রতিক্রিয়া
চট্টগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত কেটিএস গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রম নিয়ে অনাস্থা ও হতাহতের তথ্য নিয়ে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। ১৫ বছর পর আধুনিক প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগেও ঘটেছে ঠিক একই ঘটনা। উপরন্তু প্রমাণ হয়েছে রাষ্ট্রের পুলিশি ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার।
কেটিএসের ঘটনায় শ্রমিক ও জনগণ বিক্ষোভ-ভাঙচুরের মাধ্যমে প্রতিবাদ দেখায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন, হয়তো বাধ্য হয়েই। হাশেম ফুডসের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিক ও জনগণ তথ্যপ্রাপ্তিতে প্রশাসনের অসহযোগিতার অভিযোগে বিক্ষোভ দেখালে র্যাব-পুলিশ চড়াও হয়ে তাদের এলাকাছাড়া করে। বিক্ষুব্ধ জনগণ তথ্য গোপনের অভিযোগে সাংবাদিকদেরও সমালোচনা করে। ইট-পাটকেল ছুঁড়ে পুলিশের ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেলের জবাব দেয় তারা।
পুলিশ ছিল এই বিক্ষোভ সামাল দেয়ার ব্যাপারে খুবই আত্মবিশ্বাসী। এই প্রতিবেদকের সামনে দাঁড়িয়েই হাসিমুখে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার অধীনস্তদের গুলি ছোঁড়ার জন্য বন্দুক বের করতে বলেন এবং মন্তব্য করেন যে, আমরা ৪০ জনই চার হাজারের সমান। কেটিএসের মতো এবারের ঘটনায় চলমান প্রধানমন্ত্রীকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মতো কোনো চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এখানে উল্লেখ্য যে, হাসেম ফুডসের মালিক আবুল হাসেম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং দলটির হয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন।
ব্যবধান ১৫ বছর
কেটিএস ও হাসেম ফুডসের মধ্যে সময়ের ব্যবধান দেড় দশকের। এই ১৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলা হয়। চলতি বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জানানো হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে দেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১ হাজার ৬৮৪ মার্কিন ডলার বা টাকা ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রায়। এই ১৫ বছরে দারিদ্র্যের হারও কমে অর্ধেক হয়েছে। জিডিপির আকার প্রায় ৫ লাখ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা।
কেটিএসে যখন আগুন লাগে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ তখন ১০০ কোটি টাকার কম ছিল। আর সেজান গ্রুপের কারখানায় যখন আগুন লাগে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ তখন ৪ হাজার ৪০০ কোটি পেরিয়ে গেছে। কিন্তু নিরাপদ শ্রম পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারের ‘উন্নয়ন বীর’দের কোনো কৃতিত্ব বা দৌড়ঝাঁপ নেই। ১৫ বছর আগে চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে যা ঘটেছিল সেই একই ঘটনাবলিই যেন পুনরায় মঞ্চায়িত হলো নারায়ণগঞ্জে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, কেটিএসে আগুন লাগার বছরে বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা, যা ১৫ বছরে ১০ গুণ বেড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট থেকে ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুতের সুবিধাভোগী ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৯ শতাংশ। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ৭ বছরের বেশি।
কেটিএসে যখন আগুন লাগে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ তখন ১০০ কোটি টাকার কম ছিল। আর সেজান গ্রুপের কারখানায় যখন আগুন লাগে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ তখন ৪ হাজার ৪০০ কোটি পেরিয়ে গেছে। উন্নয়নের সূচকগুলো বলছে, গত ১৫ বছরে দেশে তীব্র গতিতে উন্নয়ন ঘটেছে- কোথাও ১০ গুণ, কোথাও ৪০ গুণ। কিন্তু কারখানায় শ্রম পরিবেশ আমলে নিলে দেখা যায় শ্রমিকের জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জোরকদমে উল্টোপথে হাঁটছে। নিরাপদ শ্রম পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারের ‘উন্নয়ন বীর’দের কোনো কৃতিত্ব বা দৌড়ঝাঁপ নেই। ১৫ বছর আগে চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে যা ঘটেছিল সেই একই ঘটনাবলিই যেন পুনরায় মঞ্চায়িত হলো নারায়ণগঞ্জে।
তদন্ত প্রতিবেদনেও উন্নতি নেই
১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিশাল উন্নতির এরকম অনেক চিত্রই তুলে ধরা হয়। কিন্তু তার বিপরীতে জনগণের জীবন-মাল রক্ষায় সাফল্য/ব্যর্থতার হার নিয়ে আলাপে সরকারপক্ষের আগ্রহ দেখা যায় না। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হয়। সেই তদন্ত প্রক্রিয়াও পড়ে আছে ১৫ বছর বা তারও আগের বৃত্তেই।
কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতর থাকলেও তাদের কাজের কোনো ফলাফল নেই। সরকার পরিবর্তনের মতো দাফতরিক বদলির সূত্রে এখানেও অনেক কর্মকর্তা আসে যায়। কিন্তু কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সুবিধা এই দফতরটি কখনোই নিশ্চিত করতে পারেনি
আগুন লাগার পর নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি গঠন, সেই কমিটির প্রতিবেদন গোপন রাখা কিংবা প্রকাশের পর তার সুপারিশ আমলে না নেয়া- এ সবই অনড় নিয়মে পরিণত হয়েছে। ১৫ বছর ধরে এসব প্রতিবেদন তৈরির প্রক্রিয়া, ভাষা ও বক্তব্যও একই জায়গায় রয়েছে, কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
কারখানাগুলোতে আগুন নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা কেন থাকে না, তা দেখার জন্য কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতর থাকলেও তাদের কাজের কোনো ফলাফল নেই। ১৫ বছর ধরে এই জায়গাটিও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। সরকার পরিবর্তনের মতো দাফতরিক বদলির সূত্রে এখানেও অনেক কর্মকর্তা আসে যায়। কিন্তু কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সুবিধা এই দফতরটি কখনোই নিশ্চিত করতে পারেনি। দেখা যাচ্ছে, হাকিম নড়ছে কিন্তু শ্রমজীবীদের বেলায় এই হুকুমগুলো একটুও নড়ছে না।