যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি রাজাকার!

Daily Nayadiganta১৭ ডিসেম্বর ২০১৯

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালের দালাল আইনে মামলা করা হয়েছিল তাদেরকে রাজাকার আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর সদস্য হিসাবে চিহ্নিত করে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ তালিকা প্রকাশ করেছেন।

মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে রোববার সচিবালয়সংলগ্ন সরকারি পরিবহন পুল ভবনের ছয়তলায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এ তালিকা ঘোষণা করা হয়। একদিন যেতে না যেতেই তালিকা নিয়ে বিতর্ক হতে শুরু করেছে।

রাজশাহী বিভাগের ৮৯ নম্বর তালিকায় (ক্রমিক নম্বর ৬০৬) আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রাজশাহীর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুসহ পাঁচজনের নাম এসেছে। এই পাঁচজন এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। আবার তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট মহসিন আলীর নামও রয়েছে সেই তালিকায়।

প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় রাজশাহী বিভাগের ১ থেকে ১৫৪টি তালিকা রয়েছে। এই তালিকায় কয়েক শ’ ব্যক্তির নাম রয়েছে। রাজশাহী বিভাগের রাজাকারদের তালিকায় যে নামগুলো রয়েছে ৮৯ নম্বর তালিকায় থাকা পাঁচজনের মধ্যে অপর দু’জন হলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুর রউফ ও পুলিশ কর্মকর্তা এস এম আবু তালেব।

যদিও এই ৮৯ নম্বর তালিকার মন্তব্যের ঘরে লেখা আছে তাদের অব্যাহতি দিতে জেলা কমিটি আবেদন করেছিল। এর বাইরে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। সেই হিসেবে ধরে নেয়া হয় এই পাঁচ ব্যক্তি রাজাকার ছিলেন না বলেই তাদের অব্যাহতি দিতে আবেদন করা হয়েছিল।

এ দিকে রাজাকারদের প্রকাশিত তালিকায় গেজেটেড এক মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেছে। ওই মুক্তিযোদ্ধার নাম অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী। যার ক্রমিক নম্বর ১১২, পৃষ্ঠা নম্বর ৪১১৩। তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়ে থাকেন। কিন্তু রাজাকারের প্রকাশিত তালিকায় ৬৩ নম্বর স্থানে রয়েছেন তপন কুমার চক্রবর্তী। একই সাথে এই মুক্তিযোদ্ধার মাকেও রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার মেয়ে ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়রপ্রার্থী বাসদ নেত্রী ডা: মনীষা চক্রবর্তী। এটিকে নিজের ‘রাজনীতির খেসারত’ আখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বরিশালের সদস্য সচিব এই মুক্তিযোদ্ধাকন্যা।

ফেসবুকে ডা: মনীষা চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ কাজ করার পুরস্কার পেলাম আজ। ধন্যবাদ আওয়ামী লীগকে। সদ্য প্রকাশিত রাজাকারদের গেজেটে আমার বাবা এবং ঠাকুরমার নাম প্রকাশিত হয়েছে। আমার বাবা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী একজন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা, ক্রমিক নং ১১২ পৃষ্ঠা ৪১১৩। তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়ে থাকেন! আজ রাজাকারের তালিকায় তিনি ৬৫ নম্বর রাজাকার।’

‘আমার ঠাকুরদা অ্যাডভোকেট সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তিনিও ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। তার সহধর্মিণী আমার ঠাকুরমা উষা রানী চক্রবর্তীকে রাজাকারের তালিকায় ৪৫ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের জন্য আমার রাজনীতি করার খেসারত দিতে হচ্ছে আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে। ধন্যবাদ আওয়ামী লীগ সরকারকে।’

‘আমার দল বাসদ আমাকে শিখিয়েছে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করাকে। মিছিল থেকে গ্রেফতার করে থানায় নির্যাতন করে ওরা বলেছিল যে আন্দোলন যেন না করি, নির্বাচনে যেন অংশ না নিই। রাজি না হওয়ায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে অজামিনযোগ্য মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ করেছে। আমরা জেল খেটেছি, নির্যাতন সহ্য করেছি কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথানত করিনি।’

‘ভয় দেখিয়ে বা বিপদে ফেলে আমাদের কিছু করা যাবে না। অভুক্ত, অর্ধভুক্ত গরিব খেটে খাওয়া মানুষ আছে আমাদের দলের সাথে। আছে অনেক শুভাকাক্সক্ষী। অতীতের মতো আজ এবং আগামীতে আপনাদের পাশে পাবো সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।’

এ দিকে বরিশাল বাসদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই ডা: মনীষার পরিবারবর্গের নাম রাজাকারের তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। বাসদের নেতাকর্মীদের নানাভাবে নিয়মিত হুমকি দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ডা: মনীষার পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে এলাকায় সুপরিচিত। রাজাকারের তালিকায় দুই মুক্তিযোদ্ধার নাম চলে যাওয়ায় এই তালিকার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাসদের নেতাকর্মী এবং স্থানীয় মানুষ।