সাঈদ ইফতেখার আহমেদ :
বাংলাদেশে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের কিছু নাগরিকের বিরুদ্ধে ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। শুধু বাংলাদেশ নয়, চলতি বছর বিভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্র আরও কয়েকটি দেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ দেশগুলো হলো– নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, হাইতি, সুদান, কম্বোডিয়া ও নিকারাগুয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয় হওয়ার কারণে কতজন বা কাদের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা জানানো হয়নি। জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। লক্ষণীয় যে, সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করলে বিরোধী দলও এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে বলে বলা হয়েছে। এর আগে নাইজেরিয়া, উগান্ডা, সোমালিয়া ও কম্বোডিয়ায় ব্যক্তিবিশেষের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হয়েছে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর। ফলে অনেকে মনে করেছিলেন, বাংলাদেশেও হয়তো নির্বাচনের পরে এ-সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও নিকারাগুয়া হচ্ছে দুটি রাষ্ট্র, যাদের ওপর নির্বাচনের আগেই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
রাশিয়া এবং ইরানের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিকও মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন। রাশিয়ার যে সমস্ত মিডিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসনের পক্ষে, তাদের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। অন্যদিকে, মাহশা আমিনির হত্যাকাণ্ডের পর, ইরানের যে সমস্ত মিডিয়া শিয়া ইসলামপন্থি রেজিমকে সমর্থন করেছে এবং হিজাববিরোধী বিক্ষোভের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাদেরও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।
পররাষ্ট্র দপ্তরের ঘোষণায় না থাকলেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধা প্রদানের কাজে সহায়তা করলে, বাংলাদেশের মিডিয়াও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারে। এ বক্তব্য ভিসা বন্ধের পদক্ষেপের পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
মিডিয়াকে নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত করার মধ্য দিয়ে একটা কঠিন বার্তা দিতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কেননা, নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে অন্য কোনো দেশের মিডিয়াকে এর আগে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়নি। এর মধ্য দিয়ে তারা বোঝাতে চাচ্ছে, রাশিয়া ও ইরানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যতটা সিরিয়াস, বাংলাদেশের ব্যাপারেও অনেকটা তাই। ফলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের যে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত সেটি হলো, নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন না ঘটলে এবং মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিপরীতে বাংলাদেশ অবস্থান নিলে, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে হয়তো আরও কঠিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হতে পারে।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এ ভিসা নীতিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তারা বিরোধিতা করছেন না; কেননা, তারা দেখেছেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের ওপর স্যাংশন দেওয়ার পর গুম এবং বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের যে দীর্ঘ ধারা– যার সূত্রপাত হয়েছিল ২০০২ সালে ‘অপারেশন ক্লিন হার্টে’ অংশগ্রহণকারীদের দায়মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে, তার আপাত অনেকটা অবসান ঘটেছে। ফলে তাদের অনেকের মনে এ আশারও সঞ্চার হয়েছে যে, জনমতের প্রতিফলন ঘটে, এমন নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে মার্কিন ভিসা নীতি।
নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন না থাকলে, জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বিষয় থাকে না। জনমানসের একটা বড় অংশের ধারণা, এ জবাবদিহিতা না থাকার ফলে, গত প্রায় পনেরো বছর ধরে ‘বৈধ’/অবৈধ পন্থায় দুর্নীতি, টাকা পাচার, ঋণখেলাপি ইত্যাদি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে মার্কিন ভিসা নীতি দেখে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীকে যেন কিছুটা নিষ্ক্রিয়তায় পেয়ে বসেছে। রাজনৈতিকভাবে অধিক সক্রিয় হওয়ার চেয়ে এ ভেবে তারা আশার আলো দেখছেন যে, মার্কিন ভিসা নীতির প্রয়োগ, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ বিষয়ে সাম্প্রতিক প্রস্তাব ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সংসদ নির্বাচনের জন্য পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত ইত্যাদির ফলে এবার হয়তো একটা পরিবর্তন আসবে।
বিরোধী দলকে ভিসা নীতিতে যুক্ত করার ফলে, তারা এটার সঙ্গে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনকে কীভাবে সামঞ্জস্য করবে, এ দ্বন্দ্ব খুব সম্ভবত বিএনপিসহ সরকারবিরোধীদের মাঝে কাজ করছে। ফলে এ পরিস্থিতিতে গণআন্দোলনের পদ্ধতি গড়ে তোলা নিয়ে যে সংশয়ের জন্ম দিয়েছে, সেটি একটি আপাত স্থবিরতার দিকে বিরোধী রাজনীতিকে ঠেলে দিয়েছে।
এর পাশাপাশি অতীতে দুই-দুইবার বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন করার চেষ্টা, তাদের আমলেও ব্যাপক দুর্নীতি এবং টাকা পাচারের ইতিহাস ইত্যাদি জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে আশ্বস্ত করতে পারছে না, নির্বাচনের মাধ্যমে সামনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে, দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা এ প্রবণতার আদৌ অবসান ঘটবে কিনা।
এ ছাড়া জনগণের যে মৌলিক আকাঙ্ক্ষা; অর্থাৎ, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা; কাজ, শিক্ষা এবং চিকিৎসার নিশ্চয়তা প্রদানসহ রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলোর সংস্কার করে রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত, সুশাসন নির্ভর করার রূপরেখা– বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো জাতির সামনে হাজির করতে পারেনি। এ না পারার ফলে, বিরোধী দলগুলো তাদের আন্দোলনে দলীয় কর্মী এবং সমর্থকদের বাইরে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিরোধী দলগুলো যদি আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, তাহলে শুধু ভিসা নীতির ওপর ভর করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না অথবা জনমতের প্রতিফলন ঘটবে, এমন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না, এটি সহজেই অনুমেয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত এমন কোনো নির্ভরযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি, যাতে মনে হতে পারে, আগামী নির্বাচনটি ২০১৪ বা ২০১৮-এর মতো না হয়ে, জাতীয়ভাবে সর্বমহলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। আর জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য হলেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর কাছে নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হবে। এর বাইরে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা মাপার অন্য কোনো মানদণ্ড যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউর কাছে নেই।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ সেসব দেশের নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন তোলে যেসব দেশে নির্বাচন প্রধান বিরোধী দলগুলো, সিভিল সোসাইটি এবং জনগণের বড় অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এই জায়গাটিতে যে, তারা যদি ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে তারা সেটিকে কীভাবে প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক অংশীজনের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে, সে সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা এখনও জাতির সামনে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এত রক্ত খুব কম জাতিই পৃথিবীতে ঝরিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি হচ্ছে, জনগণের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতায় এসে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই দেশের অগ্রগতির চেয়ে নিজেদের দলের লোকদের কল্যাণ সাধনে ব্যস্ত থেকেছে। এ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টার ফল হচ্ছে, সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের রূপরেখা প্রস্তুত না করা।
এখন আগামী নির্বাচনও যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে এটা অনুমেয় যে, বাংলাদেশকে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর নানামুখী চাপে পড়তে হবে। সম্প্রতি ইইউ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রসঙ্গ এনে অবাধ বাজার সুবিধা বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রাখা যৌক্তিক কিনা– এ প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ফলে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হলে, সেটিকে ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ বাংলাদেশে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করতে পারে।
এ কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশ উত্তর কোরিয়া, কিউবা বা ইরানের মতো রাষ্ট্র নয়। ওইসব রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিকাশ হয়েছে পশ্চিমা রাজনীতি এবং অর্থনীতিকে বিরোধিতা করে। শুরু থেকেই পশ্চিমা নানাবিধ স্যাংশন মোকাবিলা করেই তারা তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ অনেকটা শুরু থেকেই পশ্চিমা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের জায়গা হচ্ছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা), জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া), ও দ্য অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা)। বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক খাতসহ অবকাঠামো উন্নয়নে গণচীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ। নানাভাবে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রা বাড়ানোর প্রচেষ্টাকে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থের বিপরীতে নেতিবাচক প্রচেষ্টা হিসেবে মূল্যায়ন করে।
আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসবে, তাদের উপরিউক্ত বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কারবার করতে হবে। দেখা গেছে, যখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনমতের প্রতিফলনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়, তখন তারা জাতীয় স্বার্থের ইস্যুতে শক্তভাবে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দেনদরবার করতে পারে। কেননা, তাদের পেছনে জনগণসহ বিরোধী দলগুলোর সমর্থন থাকে।
ফলে ভিসা নীতির জন্য নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যে, নির্বাচন ব্যবস্থা সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রক্রিয়া গড়ে তোলা অতীব জরুরি। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে, এ প্রক্রিয়া গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব আওয়ামী লীগের।
ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ : শিক্ষক, স্কুল অব সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিস, আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম, যুক্তরাষ্ট্র
সমকাল