যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য নিষেধাজ্ঞা : পর্যালোচনা করছে সরকার, বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্মারকে শ্রমিকদের অধিকার হরণ করলে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা নিষেধাজ্ঞা কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে দেওয়া হবে, তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রোডম্যাপ অনুযায়ী ৯০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। সম্প্রতি পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেও তাতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন। রপ্তানিকারকদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কেননা, বাংলাদেশের একজন শ্রমিক অধিকারকর্মীকে উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বৃহস্পতিবার একটি স্মারকে স্বাক্ষর করেন।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ সমকালকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারাবিশ্বের জন্য শ্রম ইস্যুতে কথা বলেছেন। দেশটি  বাংলাদেশের  ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের পরিস্থিতিতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিতে পারে বলে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার সময় দেশে মাত্র ৩০০ ট্রেড ইউনিয়ন ছিল। এখন তা বেড়ে ১ হাজার ২০০টির বেশিতে দাঁড়িয়েছে। এখন অনেক কম শ্রমিক দিয়ে একটি সংগঠন করা যায়। এ ছাড়া গত ১০ বছরে তিনবার শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। তবে রাজনৈতিক কোনো কারণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে তা ভিন্ন বিষয়।

তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘আমরা নিজেদের স্বার্থে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছি। এমন পরিস্থিতিতে কোনো দেশের মন্ত্রী একটা কথা বলেছেন বলে অস্থির হয়ে গেছি– এমন নয়। সরকার ইতোমধ্যে শ্রম আইন সংশোধনসহ শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহী সমকালকে বলেন,  শ্রমিক অধিকার রক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে নেওয়া সরকারের কর্মপরিকল্পনা এবং আইএলওর রোডম্যাপ অনুযায়ী গত আড়াই বছরে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্জন হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের শ্রম সংক্রান্ত প্রতিনিধি প্রতি সপ্তাহে শ্রম মন্ত্রণালয়ে আসেন। এমন কোনো সমস্যা নেই, যার সমাধান করা হয়নি। কল্পনা আক্তার নামে একজন শ্রমিক অধিকারকর্মীর জীবন রক্ষায় পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অথচ কল্পনা আক্তার কোনোদিন শ্রম মন্ত্রণালয় বা এর আওতাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো অসুবিধার কথা জানাননি।

এহছানে এলাহী বলেন, শ্রমিক ইস্যুতে আইএলওতে নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে তিনি সম্প্রতি যোগ দেন। টিকফা ও ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকেও বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নেওয়া কার্যক্রমের অগ্রগতি জানানো হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের চাওয়া হয়তো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তারপরও ২০১৩ সালের পর থেকে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তারা আরও কিছু ক্ষেত্রে আইএলওর পরামর্শ মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে। বাংলাদেশ জানিয়েছে, আগামীতে এগুলোও বাস্তবায়ন করা হবে।   তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পদক্ষেপ কী হবে তা পররাষ্ট্র, আইন, বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন 
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ড. মোস্তফা আবিদ খান সমকালকে বলেন, যে দেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের ঘোষণা আসে, তার আগে একটি প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে ওই দেশের সার্বিক শ্রম পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার কথা। কিন্ত এ ঘোষণাটি বৈশ্বিক হওয়ায় হয়তো কোনো নিদির্ষ্ট দেশ রিভিউ করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকারকর্মীর নাম উল্লেখ করায় বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ বেড়েছে। আসলে কীসের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নামটি সামনে নিয়ে এলো, তা খতিয়ে দেখতে পুরো স্মারক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এখন সরকারের উচিত পুরো স্মারক বিশ্লেষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইর গবেষণা পরিচালক ড. এমএ রাজ্জাক সমকালকে বলেন, এ ধরনের নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষর করলে তারা যে কোনো দেশের ওপর তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে বেশ সক্রিয় থাকে। যে কোনো সময় যে কোনো দেশের ওপরেই তা কার্যকর করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, তারা কোনো নীতিতে স্বাক্ষর করলে তা বিশ্ব গ্রহণ করুক। তাই খুবই সতর্কতার সঙ্গে আমলে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি গ্রহণ করে তার মিত্ররা অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াও একই নীতি অনুসরণ করে। তাই দেশের সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে এ ক্ষেত্রে তাদের উদ্বেগ আমলে নিয়ে সে অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

সূত্র : সমকাল