কাগিসো রাবাদার বলে ব্যাট এবং প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড মোহাম্মদ নবী। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন কেউ কেউ। আফগানিস্তানের ভীষণ প্রয়োজনের সময় নবীর মতো কেউ দাঁড়িয়ে গেলে সেমিফাইনালে হয়তো নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হয় না।
আত্মসমর্পণ—শব্দটাই তো আফগান ক্রিকেটে ধারার বিপরীত। জন্মই যাঁদের যুদ্ধের মধ্যে, বেঁচে থাকার শ্বাসেই যাঁরা পেয়েছেন বারুদের পোড়া গন্ধ, তাঁরা কি আত্মসমর্পণ করতে জানেন! কিন্তু নবী এ বেলায় করলেন। সেটাও এমন এক বেলা, যখন আফগান ক্রিকেট–সূর্য গনগনে আলোয় উদ্ভাসিত। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল! অথচ তখনই কি না নবীর ব্যাটে গ্রহণ!
গ্রহণ যদি লাগেও নবীদের গ্রাস করা কি সম্ভব? যে লোকটি দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্ম থেকেই সারথি, নানা রকম বাধা–বিপর্যয়ে দলের জন্য খেলেছেন, লড়েছেন, তাঁকে এমন মুহূর্তে শুধু ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যায় ধারণ করা কঠিন। তাই বোল্ড হওয়ায় যে ‘কারিগরি’ ত্রুটি—সেটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে যাওয়াও অবিবেচকসুলভ।
দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে সেমিফাইনালে হারের পর আফগান অধিনায়ক রশিদ খানও উপভোগের মন্ত্রই বললেন। আত্মসমর্পণসুলভ হারের পর নতুন শুরুর প্রতিশ্রুতিও দিলেন। অর্থাৎ যে স্বপ্ন নিয়ে আফগান ক্রিকেটের যাত্রা শুরু, সেটি আজ একটি পর্যায়ে উঠে আসার পর অচিরেই শুরু হবে নতুন অধ্যায়। নবী থাকবেন সেই অধ্যায়েও। তাঁকে বাদ দিয়ে যে আফগান ক্রিকেটের ইতিহাস হয় না। ৩৯ পেরোনো নবীই তো আফগানিস্তান ক্রিকেটের ইতিহাস।
আফগানিস্তান ক্রিকেটের ইতিহাস জানা আছে অনেকেরই। একটু বয়স্ক কেউ কেউ চোখের সামনে সবকিছু দেখেছেন আর নবী সেই ইতিহাসই খেলতে খেলতে দেখেছেন। রশিদ খানের দলে এমন আর কেউ নেই। তাঁর দলে নবীর মতো আর একজনও নেই যিনি বলতে পারবেন, ‘আমার ফেলে আসা পথেই আফগান ক্রিকেট দলের শুরু থেকে বর্তমান। আমিই সেই বয়সের গাছ–পাথরহীন ক্রিকেটার, যাঁর শুরু আছে কিন্তু শেষ কবে, কেউ জানে না।’
স্বয়ং নবীও নন! অন্তত এখন পর্যন্ত। ৩৯ বছর বয়সেও যে ফিটনেস, মাঠের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ফিল্ডিংয়ে তিনি অপটু, ব্যাটিং করতে পারেন যেকোনো পজিশনে, বোলিংয়েও কিপটে—আরও ২ বছর পরেও নবী এমন থাকলে তাঁকে বাড়িতে রেখে নিশ্চয়ই ২০২৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যাবে না আফগানিস্তান!
কেউ কেউ হয়তো আজকের হারের পর থেকেই দিনটি দেখার অপেক্ষায়। কারণটা দুইয়ে–দুইয়ে চার মেলার অপেক্ষায় থাকার মতোই। নবীর ছেলে হাসান খান এইশাখিল এখন আফগানিস্তান অনূর্ধ্ব–১৯ দলের ওপেনার। কে জানে ২০২৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাপ–বেটা একসঙ্গেও খেলতে পারেন। বাবার চাওয়া কিন্তু তেমনই।
ছেলেকে তৈরির পথে নিশ্চয়ই আফগান ক্রিকেটে দাহকালের গল্পও শুনিয়েছেন। আশি–নব্বই দশকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে ‘কাচা কারা’ শরণার্থী শিবিরে সেই যে আফগান ক্রিকেটের নাড়িপোঁতা হলো, তাজ মালিক নামে এক স্বপ্নদ্রষ্টার হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে আসা, এক সময় গঠন হলো জাতীয় দল, নবী তারপর থেকেই আফগান জাতীয় দলের প্রায় সব গল্পেরই গলি–উপগলিতে ছিলেন, আছেন এবং ভবিষ্যতেও যত দিন সম্ভব থাকবেন। এ যেন একজনকে দেখলেই একটি দেশের ক্রিকেট ইতিহাস দেখা হয়ে যায়।
১৯৮৫ সালে আফগানিস্তানের লোগার প্রদেশে জন্ম নেওয়া নবীর পরিবার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন–আফগানিস্তান যুদ্ধের কারণে পাকিস্তানের পেশোয়ারে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে ১০ বছর বয়সে নবীর ক্রিকেট খেলার শুরু। অর্থাৎ সালটা ১৯৯৫। পাঁচ বছর পর পরিবারের সঙ্গে দেশে ফেরার আগেই পাকিস্তানে পেশাদার ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলেন। পাকিস্তানের সংবাদকর্মীরা এর আগে পডকাস্টে জানিয়েছেন, নবী সেখানে এবিএন–আমরো কাপ ও কায়েদে আজম গ্রেড টু ট্রফিতে খেলেছেন।
এবার কিছু বিষয়ে তাকানো যাক।
নবী যে বয়সে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন, (১৯৯৫) তখন আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের জন্ম। নবী পাকিস্তানে প্রতিযোগিতামূলক খেলা শুরুর পর আফগানিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলেরও জন্ম। ২০০১ সালে আফগানিস্তান ক্রিকেট দল পাকিস্তানে গিয়ে পেশোয়ার অনূর্ধ্ব–১৯ দলের সঙ্গে খেলেছিল। দুই বছর পরই দেশের হয়ে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেন কর্নেলিয়াস ট্রফিতে। ২০০৩ সালে রহিম ইয়ার খান অ্যাসোসিয়েশনের বিপক্ষে সে ম্যাচে ৬১ রান করে তাঁর যাত্রা শুরু।
অর্থাৎ নবীর একজীবনে তাঁর দেশে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন শাসকগোষ্ঠী এসেছে, ফিরেও গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা চলেছে, তালেবান শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হারিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র চলে গিয়েছে, তালেবানও শাসনক্ষমতায় ফিরেছে—এই যে দুই দশকের বেশি সময়ের ব্যবধানে একটি দেশে এত পালাবাদল ঘটল, মানুষ পাল্টাল, সংস্কৃতি পাল্টাল, শেলের পর শেলের আঘাতে পাল্টে গেল মানচিত্রের কিছু জায়গাও। শুধু নবী–ই এখনো টিকে আছেন আগের মতোই। ব্যাট হাতে আগের মতোই মাঠে নামছেন, বল করছেন, ফিল্ডিং করছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে খেলছেন। নবী নিজেই যেন একখণ্ড অপরিবর্তিত ইতিহাস!
আফগানিস্তানের একজন ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ারের বয়স দুই দশকের বেশি। ইএসপিএনক্রিকইনফোয় তাঁর প্রোফাইলে দেখবেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ২০০৭ সালে, লিস্ট ‘এ’ তে ২০০৮ সালে এবং আফগানিস্তান জাতীয় দলে আন্তর্জাতিক অভিষেক ২০০৯ সালে। কোনো তথ্যই ভুল নয়। কারণ, আফগানিস্তান জাতীয় দল তার আগে যা কিছু খেলেছে, সেসব ম্যাচ এই পর্যায়ের ছিল না। নবী সেই পর্যায়হীন সময় থেকেই জাতীয় দলের সারথি।
২০১২ সালে প্রথমবারের মতো আইসিসির টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে খেলেছে আফগানিস্তান। তার আগে খেলতে হয়েছে সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে। সে হিসাবে আফগানিস্তান জাতীয় দলের প্রথম ম্যাচ ছিল ২০০৪ এসিসি ট্রফিতে। নবী সে টুর্নামেন্টেও খেলেছেন। অন্য দলগুলোর সেখান থেকে যে উচ্চতায় উঠতে আরও বেশি সময় লাগে—কেউ কেউ এখনো পারেনি, যেমন বাংলাদেশ—আফগানিস্তান মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে সে উচ্চতায় (টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল) যখন উঠল, তখনো নবী খেলছেন! আর এই পথে হারিয়েছেন ৪৫টি আন্তর্জাতিক দলকে।
ফ্র্যাঞ্চাইজি টি–টোয়েন্টি লিগের এ সময়ে কারও কারও দেশের হয়ে ৪৫ ম্যাচও খেলা হয় না, নবী সেখানে ৪৫টি দেশকে হারানোর সাক্ষী। ভাবা যায়! নবীর ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ দল এবং বিভিন্ন ক্লাব দলের তালিকায় না তাকানোই নিরাপদ। গুণে শেষ করা কঠিন!
২০০৮ সালে আইসিসির ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ ডিভিশন ফাইভ পর্যায় দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল আফগানিস্তান। এই টুর্নামেন্ট জিতেই ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উঠে এসেছে দলটি। এরপর তো ২০০৯ সালে পেল সাময়িক ওয়ানডে মর্যাদা, ৮ বছর পর মিলল টেস্ট মর্যাদাও। তখন ওয়ানডে মর্যাদাও স্থায়ী করা হয়। নবী এই পুরো সময়টাই দেখেছেন, খেলেছেন। আর অবদানের কথা তুললে শুধু পরিসংখ্যানে কি এমন ক্রিকেটারকে ধারণ করা যায়?
৩ টেস্ট, ১৬১ ওয়ানডে ও ১২৯ টি–টোয়েন্টি খেলা নবী আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় ৭ হাজারের কাছাকাছি রান করেছেন। ২০১০, ২০১২ ও ২০১৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ছিলেন দলের মেরুদণ্ড। ছিলেন অধিনায়কও। ভালো ইনিংস, দল জেতানো ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিংও কম নেই। তবু পরিসংখ্যানে যেন আসল জিনিসটাই নেই! সেখানে অবশ্য এসব থাকেও না। কিন্তু আফগান ক্রিকেটে নতুন অধ্যায়ের শুরুতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—নবীদের মতো ক্রিকেটারদের শুরু আছে শেষ নেই!
একদিন তাঁকে অবশ্যই অবসর নিতে হবে। সেমিফাইনাল থেকে বিদায়ের পর আফগানিস্তান হয়তো নতুন লক্ষ্য ঠিক করবে, পরিকল্পনা করবে নতুন দিনের। খুঁজবে নতুন প্রজন্মও। নবীর যে ফিটনেস হয়তো ২০২৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপও খেলবেন এবং তারপরই সম্ভবত থামবেন। কিংবা তার আগেই, কে জানে! কিন্তু আফগান ক্রিকেটের ইতিহাস কি তাঁকে অবসর দেবে?
সেই যে ব্যাট–বল ধার করে খেলার শুরু থেকে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল—আফগান ক্রিকেটের প্রথম অধ্যায় নবী ছাড়া অসম্পূর্ণ।
prothom alo