- ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৪৫, আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৪৬
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাদ পড়ার পেছনে যে সব কারণ নিয়ে আলোচনা চলছে, তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তার অবস্থানকে দুর্বল করে কিনা- এখন এই প্রশ্নও উঠেছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, ভারতের সাথে সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর।
তারা মনে করেন, ওই দেশে শীর্ষ সফর থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাদ পড়ার ঘটনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতরেও এই ইস্যুতে আলোচনা রয়েছে যে এখন মোমেনের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন বা কাজ চালিয়ে যাওয়া কতটা সহজ হবে ।
দলটির নেতাদের অনেকে বলেছেন, যদিও অসুস্থতার কারণে শেষ মুহূর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সফরে যাননি বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে মোমেনকে নিয়ে যে অস্বস্তি তৈরী হয়েছে, সেটাও একটা বাস্তবতা।
আর এই পটভূমিতেই ভারত সফর থেকে মোমেনের বাদ পড়ার ঘটনায় তার অবস্থান কতখানি নড়বড়ে হয়ে উঠেছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বলে তারা মনে করেন।
মোমেন গত মাসেই চট্টগ্রামে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সম্প্রতি তিনি যখন ভারত সফর করেন, তখন তিনি ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে।
এই মন্তব্য করে তিনি এক প্রবল আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। আর তারপরই তিনি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর থেকে বাদ পড়েন।
কিন্তু এ খবরটিও প্রকাশিত হয়েছে গত সোমবার সকালে, প্রধানমন্ত্রী দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর।
মোমেন আগের দিনও ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে নিজের যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
কেন এত আলোচনা
সফরসঙ্গীদের তালিকাতেও তার নাম ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই সফরে মোমেনের না থাকার প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়া হয়নি।
এ-নিয়ে এক ধরনের রাখঢাক ছিল। ফলে সফর থেকে মোমেনের বাদ পড়ার ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনেও আলোচনার নতুন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
পরে অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জানান যে হঠাৎ করে উচ্চ রক্তচাপ এবং অসুস্থতার কারণে তিনি নিজে শেষ মুহূর্তে এই সফরে যেতে পারেননি। ঘটনার পরদিন মোমেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে গিয়ে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন বলে জানানো হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখন অসুস্থতার কথা বলা হলেও এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসিকে বলেন, অসুস্থতার কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেষ মুহূর্তেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো সফর বাতিল করতে পারেন।
কিন্তু যেহেতু কিছু দিন আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কিছু মন্তব্য বাংলাদেশ এবং ভারত- দু’দেশকেই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল, এমন পটভূমিতে তিনি সফর থেকে বাদ পড়েছেন এবং সেজন্যই বিষয়টি নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে।
মোমেনের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা দলের ভেতরেও নানা আলোচনা রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেও। দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, তাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর রাজশাহী থেকে আওয়ামী লীগের নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ মনে করেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করে বিতর্কের জন্ম দেয়ার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সফর থেকে বাদ পড়েছেন।
সেজন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে পরিস্থিতির একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং মোমেনের অবস্থানকে দুর্বল করবে বলে মনে করেন তিনি।
আসাদ উল্লেখ করেন, তিনি যেমনটা ভাবছেন, তাদের দলের ভেতরেও তেমন আলোচনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টা নিয়ে অনেকে নানা রকম কথা বলছে এবং অনেক ডালপালা গজাচ্ছে।’
বগুড়া, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম থেকেও দলটির কয়েকজন নেতাকর্মীর সাথে আমার কথা হয়েছে। তারাও রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতার মতো একইভাবে ভাবছেন বলে মনে হয়েছে।
তারা মনে করেন, অসুস্থতার কথা বলা হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণেই সফরে যেতে পারেননি। এই যুক্তিই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে মানুষের কাছে।
মন্তব্যের কারণেই নানা প্রশ্ন
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সিনিয়র মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগের মন্তব্যের কারণেই এখন নানা প্রশ্ন উঠছে।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি কিছু কথাবার্তা বলেছিলেন এবং তা নিয়ে অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ভারত সরকারও ভালভাবে নেয়নি বলে শুনেছি।’
‘আমাদেরও দলীয়ভাবে এটা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। এটা বাস্তব এবং সত্য,’ মন্তব্য ড. রাজ্জাকের।
তবে একই সাথে তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অসুস্থতার কথাও তারা শুনেছেন। ‘অসুস্থ হলে তিনি নাও যেতে পারেন।’
তবে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে মোমেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আগের মতোই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, নাকি বর্তমান পরিস্থিতি তার অবস্থানকে দুর্বল করবে, এসব প্রশ্ন ওয়ামী লীগের ভেতরেও উঠছে।
এ ব্যাপারে বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী মনে হয়েছে ড. রাজ্জাককে।
তিনি বলেন, তাদের সরকারের সহযোগিতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগের মতোই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন।
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে (পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন) যদি সেভাবে গাইড করেন, তাহলে সমস্যা হবে না।’
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে যেহেতু অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক নিয়ে কাজ করতে হয়, তাই কোনো বিতর্কে পড়ে গেলে তার কোনো প্রভাব মোমেনের সেই দায়িত্ব পালনের ওপর পড়বে কিনা, এই প্রশ্নও অনেকের রয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যে পরিস্থিতিতে মোমেন রয়েছেন, তা তার অবস্থানকে কিছুটা দুর্বল থাকবে। কিন্তু সেটা সাময়িক সময়ের জন্যও হতে পারে।
তারা মনে করেন, সরকারের সহযোগিতা থাকলে অবস্থানের সাময়িক দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন, ‘বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতিতেও সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী যদি সমর্থন রাখেন, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনে এ. কে. আব্দুল মোমেনের অবস্থানের সাময়িক হেরফের হলেও তা কেটে যাবে।’
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও একইভাবে দেখছেন বলেই দৃশ্যত মনে হয়েছে।
তবে দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা আমাকে বলেছেন, শেষ পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব কী হবে, তা এখনো তাদের কাছে পরিষ্কার নয়।
সূত্র : বিবিসি