মোদির দর্পচূর্ণ

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন

প্রায় তিন মাসব্যাপী ৭ দফায় অনুষ্ঠিত বিশ্বের সবচাইতে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে জুন ১, ২০২৪ এ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর ৪ঠা জুন ২০২৪ এ ভোট গণনা শেষ হয়েছে। এবারের এই নির্বাচন ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি’র এবং তার দল বিজেপি-এর টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় থাকার লড়াই। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় যে, গত দুইবারের মতো এবার নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি ২৪০ আসন পেয়ে এককভাবে ক্ষমতার দাবিদার হতে পারছে না। ২০১৯ এর নির্বাচনের তুলনায় এনডিএ জোট ৬৩টি আসন হারিয়েছে। গত নির্বাচনে বিজেপি ৩০৩টি আসন পেয়ে এককভাবে সরকার গঠন করেছিল। তবে এবার এনডিএ জোটের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৭০ হতে ৪০০ আসন। কারণ এই সংখ্যা তাদেরকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে থাকে। নির্বাচনী প্রচারণার শুরু হতেই বিজেপি- সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তর করার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিল এবং প্রচারণায় যে ধরনের সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছিল তাতে এ বিষয়ে কোনো রাখঢাক ছিল না। কিন্তু ভারতের ভোটারগণ এ প্রস্তাবে সায় দেয়নি।

এদিকে নির্বাচনপূর্ব জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স (NDA) সমষ্টিগতভাবে ২৯৩ আসন পেয়েছে। এর মধ্যে অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টি (TDP), যার প্রধান চন্দ্র বাবু নাইডু- তারা পেয়েছে ১৬ আসন।

যা গত নির্বাচন হতে ১৩ আসন বেশি এবং বিহারের জনতা দল ইউনাইটেড (JDU) পেয়েছে ১২টি আসন। যার প্রধান নীতিশ কুমার যাদব। এই দুই দল এবং ব্যক্তিই এনডিএ-এর প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হয়।

অপরদিকে দৃশ্যত রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (আইএনসি) দল হিসেবে ৯৯টি এবং ইন্ডিয়া (INDIA) সহযোগী মিলে মোট ২৪০টি আসনে জয়ী হয়েছে। এ জোটের এই নির্বাচনে দারুণ সাফল্য অনেক বিশ্লেষক এমন কি এনডিএ জোটকেও হতবাক করেছে। লক্ষণীয় যে, গত নির্বাচন থেকে এবার কংগ্রেস ৪৭ আসন বেশি পেয়েছে। তবে সবচাইতে চমক এসেছে বিজেপি’র দুর্গ বলে পরিচিত উত্তর প্রদেশে- সেখানে রয়েছে ভারতের লোকসভার সবচাইতে বেশি আসন, ৮০টি। গত নির্বাচনে মোদির ব্যাপক উত্থানের পেছনে ছিল উত্তর প্রদেশ। ৮০ আসনের মধ্যে তারা পেয়েছিল ৬২ আসন। মায়াবতীর ‘বহুজন সমাজ পার্টি’- ছিল এনডিএ’র সহযোগী। এই দলের বিপরীতে ছিলেন মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি, পেয়েছিল মাত্র ৫টি আসন।
এবার ২০২৪ সালে সেই উত্তর প্রদেশে যে চমক ইন্ডিয়া জোট দেখিয়েছে তাতে, বিশ্লেষকদের মতে বিজেপি জোটের কোমর ভেঙেছে। এবার বিজেপি ৩৩টি আসন পেয়েছে যার মানে ২৯টি কম। অপরদিকে ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ৪৩ আসন, যার মধ্যে বর্তমানে অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বে সমাজবাদী পার্টি পেয়েছে ৩৭টি আসন। তার মানে গতবার হতে ৩২টি আসন বেশি। উল্লেখ্য যে, উত্তর প্রদেশ শুধু সবচাইতে বড় প্রদেশই নয় সবচাইতে ঐতিহাসিক অঞ্চলও। এই প্রদেশই মোগল সময়ের সবচাইতে দর্শনীয় স্থান এবং মোগল রাজধানী আগ্রা, আগ্রার তাজমহল, আগ্রার দুর্গ, সেকেন্দ্রা এবং সম্রাট আকবরের এক সময়কার রাজধানী ফতেহপুর সিক্রি। একই সঙ্গে হিন্দু ধর্মের পবিত্র স্থানগুলো এখানে, যার মধ্যে ভগবান রাম-এর জন্মভূমি বলে পরিচিত অযোধ্যা, তীর্থস্থান মথুরা, বারানসী এবং বিখ্যাত ঝাঁসী। উত্তর প্রদেশের ঐতিহাসিক রাজধানী নবাবদের শহর লক্ষ্ণৌ। এই প্রদেশে জনসংখ্যার প্রায় ২০% মুসলমানের বাস। সঙ্গে বড় সংখ্যক নিম্নবর্গের মানুষ মিলে মোট জনসংখ্যা ২৪ কোটির উপরে। কাজেই বলা হয় উত্তর প্রদেশের পরেই রয়েছে দিল্লির মসনদ যা ঐতিহাসিক সত্য।

এই উত্তর প্রদেশই এবার বিজেপি’র ভরাডুবির প্রধান কারণ। নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে সবচাইতে চমক যুগিয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয় অযোধ্যায় বিতর্কিত বাবরী মসজিদ। এর ভগ্নস্তূপের উপরে গড়ে ওঠা বিশ্বব্যাপী আলোচিত জানুয়ারি ২২, ২০২৪ সালে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে মোদি কর্তৃক রাম জন্মভূমি মন্দির। এই অনুষ্ঠান প্রায় ৩৬ ঘণ্টা সরাসরি প্রচার করা হয়। করা হয় ভগবান রাম-এর প্রাণ প্রতিষ্ঠা। প্রায় ৩ লাখ ভক্তের মাঝে মোদি একাই প্রবেশ করেন। ধারণা করা হয়েছিল এর মধ্য দিয়েই বিজেপি এবং ৫৪৩ আসনের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ৪০০ আসন পার করে ভারতের সংবিধানের খোলনলচে পরিবর্তন করবে। স্লোগান হলো ‘আব কি বার চারশ পার’ (এবার ৪০০ পার হবে)। অথচ অযোধ্যার অন্তর্গত ফয়েজাবাদ আসনই মোদি তথা বিজেপিকে ২০২৪- এর নির্বাচনে ৫৪,৫৬৭ ভোটে সমাজবাদী পার্টির আওয়াদেশ প্রাসাদ বিজেপি’র লালু সিংকে হারিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। তিনি সমাজবাদী পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ফায়জাবাদের ফলাফল শুধু বিজেপি’র ভরাডুবিই নয় বরং বিজেপি’র ধর্মীয় কার্ড সাধারণ জনগণ যে প্রত্যাখ্যান করেছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ। একই সঙ্গে উত্তর প্রদেশ তথা মুসলমান বিরোধী এবং নিম্নবর্গের হিন্দুদের অবহেলার কারণে উত্তর প্রদেশ থেকে বিজেপি’র ৬ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরাজয়বরণ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছেন অতি পরিচিত মুখ স্মৃতি ইরানি।
শুধু উত্তর প্রদেশেই নয় সাম্প্রদায়িকতানির্ভর প্রচারণা পশ্চিমবঙ্গেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই প্রদেশে তৃতীয় বৃহত্তর আসন সংখ্যা মোট ৪২টি। ২০১৯ সালে শাসক দল মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ২২টি আসন, বিজেপি পেয়েছিল ১৮টি এবং কংগ্রেস পেয়েছিল ২টি। এবার বিজেপি ৬টি আসন কম এবং কংগ্রেস পূর্বের ২টির জায়গায় পেয়েছে মাত্র ১টি। তৃণমূল শক্ত অবস্থানে উঠেছে মোট ২৯ আসন পেয়ে, গত নির্বাচন থেকে ৭টি বেশি। এই ফলাফল বিশেষজ্ঞদেরকেও হতবাক করেছে। ধারণা করা হয় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, অত্যন্ত কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে তৃণমূল কংগ্রেস এবং নেতৃত্বের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে এই চমকপ্রদ ফলাফল।

যাই হোক বিজেপি’র জন্য এই দুই প্রদেশে ভরাডুবি- ৪০০ আসন তো নয়ই ২৭২টি আসনও জনগণ দেয়নি। এ কারণেই নরেন্দ্র মোদিকে তার প্রধানমন্ত্রিত্ব ধরে রাখতে হলে এমন দু’জনের সহযোগিতা নিতে হবে যাদের বিজেপি’র সঙ্গে অতীত তিক্ততা ভুলতে হবে। তাছাড়া আগামী কয়েকদিন ব্যাপক দেয়া-নেয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে বিজেপি’র এই বিপর্যয়ের বহুবিধ কারণের মধ্যে মোদির উন্মত্ত ধর্মীয় সংকীর্ণতা, যার সহায়ক ছিলেন অমিত শাহ এবং ক্রমেই একনায়ক হয়ে ওঠা। মোদিই ভারতের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি প্রকাশ্যে ধর্মান্ধতার পরিচয় দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তাতে শুধু সংখ্যালঘুদেরই নয় উদারপন্থি বেশির ভাগ ভোটার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

এবারের নির্বাচনে বহু বিষয় উঠে এসেছে। সরকারি দল ভারতের বিশাল জনসংখ্যার চাহিদা যেমন পূরণ করতে পারেনি তেমনি নির্বাচনী প্রচারে এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনার কোনো আশ্বাসই পায়নি সাধারণ ভোটারগণ। এর মধ্যে রয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, উচ্চ হারের বেকারত্ব, বিগত করোনার সময়ের অব্যবস্থা এবং উচ্চ মাত্রার দুর্নীতি। এ ছাড়াও বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, নাগরিকত্ব আইন এবং ‘গৌরক্ষা’ বা গরু রক্ষার আবরণে সংখ্যালঘু নির্যাতন বড় ধরনের কারণ বলে মনে করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিরোধীদের বিভিন্নভাবে দমন পীড়নের বিষয়।

যাই হোক এই নির্বাচনে বিজেপি’র ভরাডুবিকে তেমন ভরাডুবি না আখ্যা দিলেও যে অবস্থায় পড়েছে তাকে রাজনৈতিক দর্পচূর্ণ বলা যায়। এমনই হওয়ার কথা আমি আমার পূর্বতন বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছিলাম। এখন লক্ষণীয় যে, জোট সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, যদি বিজেপি’র নেতৃত্বে হয় তার ভবিষ্যৎ এবং রাজনৈতিক প্রভাব আগের মতো থাকে কিনা, না অল্প সময়ে ভারতে আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের পথে চলবে। কারণ ভারতের মতো বিশাল দেশ, শত সমস্যা এবং বিশ্ব ভূ-রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনের আবর্তে এ ধরনের জোট সরকারের পক্ষে সন্নিবেশিত সিদ্ধান্ত নেয়া দুষ্কর হলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দারুণ প্রভাব পড়বে।
আমরা অন্যতম বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে আশা করবো যে, ভারত অতীতে যে উদার গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ হিসেবে ছিল পুনরায় সেই উদাহরণ হতে পারবে।

লেখক: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

manabzamin