মেঘনা গ্রুপের জালিয়াতি
একই জাহাজ দুইবার কিনে ১০০ কোটি টাকা পাচার
বিদেশে টাকা পাচার করতে একটি জাহাজ দুবার কিনেছে মেঘনা গ্রুপ। খোলা পণ্যবাহী বড় জাহাজটির নাম ‘ওশান প্যারাডাইজ’, যেটি নামবদল হয়ে এখন ‘মেঘনা প্যারাডাইজ’। জাহাজটি এখন মেঘনা গ্রুপের হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করছে।
একই জাহাজ দুবার কেনাবেচার মাধ্যমে অন্তত ১০০ কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মেঘনা গ্রুপের নতুন কারখানা সুগার রিফাইনারির মেশিনারিজ আমদানির মাধ্যমে এই টাকা পাচার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ‘ওশান প্যারাডাইজ’ জাহাজটি প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্শাল আইল্যান্ড দেশের পতাকাবাহী অর্থাৎ মার্শাল আইল্যান্ড থেকে নিবন্ধিত হয়ে বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহন করছিল। জাহাজটি তৈরি হয়েছে ২০০৬ সালে জাপানের ইমবারি শিপ বিল্ডিং কম্পানিতে। ১২ বছর চলার পর পুরনো এই জাহাজ ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে কিনে নেন মেঘনা গ্রুপের মালিক মোস্তফা কামালের একমাত্র সন্তান তানভীর আহমেদ মোস্তফা। বিদেশে ইমপেরিয়াল ট্রেডিং কম্পানি লিমিটেডের নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে সাড়ে ৬২ লাখ মার্কিন ডলারে জাহাজটি তিনি কিনে নেন। রিপাবলিক অব মার্শাল আইল্যান্ডের মেরিটাইম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর গাই ই সি মাইথার্ড ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি সেটির নিবন্ধন সনদে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু সেই টাকা কোত্থেকে এলো এবং বাংলাদেশ থেকে টাকা কিভাবে সেই প্রতিষ্ঠানে গেল, তার কোনো হদিস নেই।
জানা গেছে, তানভীর আহমেদ মোস্তফার নামে কেনা ওশান প্যারাডাইজ জাহাজটি মেঘনা গ্রুপের সিমেন্ট ক্লিংকারসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানির কাজে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি দেখানো হতো ভাড়া হিসেবে, যাতে পণ্য পরিবহন ভাড়ার টাকা শিপিং খরচ হিসেবে বিদেশে পাচার করা যায়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাহাজ কেনার পর ৯ মাস ধরে পণ্য পরিবহনের পর এই জাহাজ ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে আবার কেনা হয় ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজের নামে। ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ মেঘনা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান।
এবার কেনা দেখানো হয় সিঙ্গাপুরের জাহাজ ব্রোকার প্রতিষ্ঠান অলইউনাইটেড অ্যান্ড ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড থেকে। তাদের ঠিকানা ৩ শেনটন ওয়ে, ১৩ শেনটন হাউস, সিঙ্গাপুর। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মোহাম্মদ ইরশাদ আলী জাহাজ বিক্রয়পত্রে স্বাক্ষর করেন। তিনি ৬২ লাখ ৪২ হাজার মার্কিন ডলারে (বাংলাদেশি টাকায় ৫৩ কোটি টাকা) এই জাহাজ বিক্রি করেন ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে। আর এ ক্ষেত্রে টাকা দেওয়া হয় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ঢাকা শাখার ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ নামের অ্যাকাউন্ট থেকে। জাহাজটি কেনার জন্য ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ঢাকার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে সাত বছর মেয়াদি ঋণ নেয়। ধাপে ধাপে সেটি পরিশোধ করবে মেঘনা গ্রুপ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অলইউনাইটেড অ্যান্ড ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক বাংলাদেশি নাগরিক। তাঁরা মূলত কমিশনে জাহাজ বিক্রি করে থাকেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ‘ওশান প্যারাডাইজ’ জাহাজটি অলইউনাইটেড অ্যান্ড ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেডের মালিকানাধীন হলো কিভাবে? কারণ ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এই জাহাজের মালিক মেঘনা গ্রুপের পরিচালক তানভীর আহমেদ মোস্তফা। আবার ৯ মাসের ব্যবধানে একই জাহাজের মালিক বনে যায় অলইউনাইটেড অ্যান্ড ট্রেডিং। সেই একই জাহাজ অলইউনাইটেড থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বরে আবার কিনে নেন তানভীর মোস্তফা।
অভিযোগ উঠেছে, মূলত একই জাহাজ দুবার কেনার নামে টাকাটা মেঘনা গ্রুপ নিজেদের মধ্যে হাতবদল করেছে। আর সব টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করেছে গ্রুপটি। ওশান প্যারাডাইজ জাহজটি প্রথমবার কেনার ক্ষেত্রে টাকা লেনদেন হয়েছে বিদেশে। কিন্তু সেই টাকা কিভাবে এবং কোত্থেকে এলো? বাংলাদেশ ব্যাংক এর অনুমোদন দিয়েছে কি না তার কোনো হদিস নেই।
ধারণা করা হচ্ছে, মেঘনা গ্রুপের তিনটি জাহাজ এখন পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত। এগুলো হচ্ছে ‘ওশান প্যারাডাইজ’, ‘ওশান প্রগ্রেস’ ও ‘ওশান স্পিরিট’। সব খোলা পণ্যবাহী জাহাজ। সব জাহাজ কেনার ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। সব টাকাই পাচার করা হয়েছে। সূত্র মতে, বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের পরই সব বেরিয়ে আসবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যত বড় অনিয়ম হয়েছে তার জন্য মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলা হতে পারে; একই সঙ্গে প্রতারণার জন্যও মামলা হতে পারে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হলেও অভিযোগ আমলেই নেওয়া হয়নি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের কোনো অভিযোগের বিষয় আমার নলেজে নাই। এর পরও আমি খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাব।’
এদিকে দ্বিতীয়বার জাহাজটি কেনার পর ‘ওশান প্যারাডাইজ’ জাহাজের নাম পরিবর্তন করে ‘মেঘনা প্যারাডাইজ’ রাখা হয়। নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তর ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর জাহাজের নাম পরিবর্তনের এই অনুমোদন দেয়। এখন সেটি বাংলাদেশি পতাকা ধারণ করে পণ্য পরিবহন করছে। এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তাফা কামালের সেলফোনে একাধিকবার কল দিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি।