- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:৫৯
ঋণ উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত দেশের জন্যও একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে তা হতে হবে পরিশোধের সাধ্যের মধ্যে এবং তার ব্যবহার হতে হবে যথাযথ। আগে বাংলাদেশ যে বৈদেশিক ঋণ করেছিল তা সাধ্যের মধ্যে ছিল বিধায় পরিশোধে সমস্যা হয়নি। কিন্তু গত পাঁচ বছরে হঠাৎ করে মেগা ঋণ করে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মেগা সঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে পড়ে দেশ। দেশের এই ঋণের পরিমাণ ও তার পরিশোধ ক্ষমতা নিয়েই আজকের আলোচনা।
দেশের বর্তমান ঋণের অবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের শেষে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে যা ২০২৪ সাল শেষে দাঁড়াবে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলে দেশে রেকর্ড ১৭ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণ তৈরি হয়েছে। বিদেশী এই ঋণের ৫৭ শতাংশই বৈদেশিক বাণিজ্যের দায়বিলম্বের কারণে সৃষ্ট। এ সময় করোনাভাইরাসসৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগের কারণে আমদানি দায় পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ২০২১ সালের মোট আমদানি দায়ের ৩০ শতাংশ বিদেশী ঋণে রূপ নেয়। আমদানি দায় অপরিশোধিত থাকার কারণে স্বল্পমেয়াদি এ বিদেশী ঋণ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশগুলোর একটি। করোনার আগের পাঁচ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় ছিল ৭ শতাংশ। জিডিপির এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকার ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব থেকে এবং দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে এ সময়ে বিনিয়োগ করেছে। এ কারণে দেশের জাতীয় সঞ্চয় ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও বিনিয়োগ হয়েছে ৩১ শতাংশ; অর্থাৎ সঞ্চয়ের চেয়ে বিনিয়োগ বেশি। সঞ্চয় ও বিনিয়োগের এই ব্যবধানই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
গত কয়েক বছর কৃত্রিম উপায়ে ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। অথচ এ সময় নমিনাল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের (এনইইআর) ভিত্তিতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৭ টাকা ৭২ পয়সা। অন্যদিকে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের (আরইইআর) ভিত্তিতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১৬ টাকা ৩৮ পয়সা। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য বেড়ে যাওয়া একই পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে দেশীয় মুদ্রায় খরচ প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে বিদেশী উৎসের ঋণ দ্বিগুণ হলেও সরকারি ঋণের চেয়ে এ সময়ে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল অনেকগুণ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশী উৎস থেকে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০২২ সালের জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ছয় হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশ। মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে ব্যাপকভাবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ মতে, বাংলাদেশের ২০২০-২১ সালের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ চার হাজার ২৭১ টাকা থেকে বেড়ে পাঁচ হাজার ৬৮২ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৪১১ টাকা।
বেসরকারি খাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের মধ্যে ৪১০ কোটি ডলার নিয়েছেন বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ কোম্পানি ছাড়াও রফতানি আয় নেই এমন অনেক শিল্পোদ্যোক্তা বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ডলারের সঙ্কট ও দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ক্ষতির মুখে। অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতির অজুহাতে বিদেশী ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করতে চাচ্ছেন। এ অবস্থায় অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে ঋণের অর্থ জোগানদাতা ব্যাংকগুলোও বিপদে পড়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে সরাসরি বিদেশী ঋণ নিয়ে আসা কোম্পানিগুলোও যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ করা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে।
রেকর্ড এলসি দায় পরিশোধের পাশাপাশি, সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে দিশেহারা পরিস্থিতি পার করছে দেশের ব্যাংক খাত। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তীব্র ডলার সঙ্কটের কারণে অনেক ব্যাংক চাইলেও যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার বিদেশী ঋণের কিস্তির ডলার সংস্থান করতে পারছে না কিছু ব্যাংক। এ অবস্থায় প্রতিনিয়ত বাজারে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করেছে প্রায় ৭৫০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে এই বিক্রির পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হবে। অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করায় দেশের ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে যা গত বছরের একই সময় ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
২০২৩ সাল থেকে যে ঋণ পরিশোধ করতে হবে
চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেই ২০২৩ সাল থেকেই কিছু বড় প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ শুরু হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মতে, ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে পরিশোধ করতে হয়েছিল ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দেশের বেসরকারি খাত প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার ও বাকি পাঁচ বিলিয়ন ডলার সরকার পরিশোধ করেছে। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। তার সাথে বাড়তি ঋণ পরিশোধের চাপ পড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে যাবে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মেগা প্রকল্পে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসছে। ২০২৭ সালে গিয়ে সেটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং আরো কয়েক কয়েক বছর পর্যন্ত চলবে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে চীন, ভারত ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ঋণের সুদেআসলে পরিশোধ শুরু হবে। এর বাইরে অন্যান্য খাতে নেয়া ঋণও সুদেআসলে এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে রিজার্ভে চাপ আরো বাড়বে। এদিকে স্বল্পমেয়াদি বেশ কিছু ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মেগা প্রকল্পে ঋণ পরিশোধের সময় যত এগিয়ে আসছে, অর্থনীতির জন্য তত চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশেষ পরিকল্পনা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, দেশের ২০টি বড় প্রকল্পের অন্যতম হলো- পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ ইত্যাদি। এসব প্রকল্পে প্রায় পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ বিদেশী ঋণ। বলা যায়, ২০০৯ সাল থেকে বড় প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের ঐকমত্য করেছে সরকার। বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখা যায় বলে রাজনীতিবিদরা এতে আগ্রহ দেখান। এ ছাড়াও সাধারণের ধারণা, দুর্নীতিবাজদেরও মেগা দুর্নীতি করার সুযোগ রয়েছে এই মেগা প্রকল্পে। ওই ২০টি প্রকল্প ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সব কটি শেষ করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে এক ধরনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে বলেও মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
ইআরডির তথ্য মতে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশিয়া থেকে নেয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে ২০২৭ সালে শুরু হবে মূল ঋণের কিস্তি। ২০২৭ সালেই ২৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার করে দুই কিস্তিতে দিতে হবে ৫৬ কোটি আট লাখ ডলার। এ ঋণের সুদের হার লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফারড রেটের (লাইবর) সাথে পৌনে ২ শতাংশ যোগ করে নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে ছয় মাস মেয়াদি ডলার বন্ডের সুদের হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এর সাথে পৌনে ২ শতাংশ যোগ করলে সুদের হার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরের মধ্যে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন-৬-এর মেট্রোরেল নির্মাণের ব্যয় প্রথমে ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি সাত লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকার সহায়তা ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা যা পর্যায়ক্রমে দিচ্ছে। এসব ঋণের রেয়াতকাল শেষে ২০২৮ সালে মূল ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ২০২৯-৩০ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ৫১৫ কোটি ডলার খরচ হবে। এরপর বর্তমান ঋণ পরিশোধ হয়তো কমতে থাকবে। তবে বিদ্যমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী তিন বছর বাংলাদেশের ক্রমপুঞ্জীভ‚ত ঋণের অঙ্কও বাড়তে থাকবে।
সূত্র মতে, বর্তমানে চীনের কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে ২১টি ঋণ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। এসব ঋণের বর্তমানে শুধু সুদের অংশ কিস্তি হিসেবে নেয়া হচ্ছে। রেয়াতকাল শেষে সুদ ও আসল দুটো মিলেই পরিশোধ করতে হবে। পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছরের মধ্যে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ প্রকল্পে চীনের ঋণ রয়েছে ১৯৫ কোটি ডলার। ২০২৩ থেকে শুরু হয়ে ২০৩১ সালের মধ্যে পুরো ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ বেশ চাপে পড়েছে। ২০২০ সালে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ৩৭৩ কোটি ডলার সুদ পরিশোধ করা হয়েছিল। ২০২২ সালে একই খাতে ঋণ ও সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৫৩০ কোটি ডলার। প্রতি বছরই পরিশোধের হার বাড়ছে। এর বাইরে স্বল্পমেয়াদি ঋণও পরিশোধ করতে হচ্ছে। এগুলোর দায় আরো বেশি।
ঋণ ফোবিয়া থেকে বাঁচতে হলে এখন যেসব ঋণের সুদ বেশি ও কঠিন শর্তযুক্ত সেগুলো নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ও আয়ের মূল্যায়ন করতে হবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বড় চাপ এলে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে সমস্যা তৈরি হবে। সেই সাথে টাকার মান দুর্বল হয়ে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিসহ নানা ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ফলে সতর্ক ব্যবস্থা হিসেবে এখন থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর চেষ্টা করতে হবে।
ইআরডির সচিব শরিফা খান অবশ্য ভিন্ন কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো সক্ষমতার দিক থেকে অনেক কম ঋণ নিচ্ছি। তবে আপাতত কম সুদে ও সহজ শর্তের ঋণ বেশি গ্রহণ করা হচ্ছে। কেননা, আগামীতে এলডিসি উত্তরণ ঘটলে সহজ শর্তের ঋণ আর পাওয়া যাবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশ কখনো ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়েনি এবং কোনো কিস্তিও বাকি পড়েনি। এবারো পড়বে না।’ আমরা মনে করি- তাই যেন হয়, তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। কারণ বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন আগের চেয়ে অনেক সঙ্কটাপন্ন, তেমন ঋণের পরিমাণও বহুগুণে বেশি।
বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিদেশী দায়দেনা পরিশোধ করা হয় ১ দশমিক ১ শতাংশের মতো। ২০২৬ সাল নাগাদ তা দ্বিগুণ হতে পারে। এই হার ২ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন ও জাপানকেই বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তার মধ্যে চীনের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বেশ কম। তখন বাংলাদেশ সমস্যায় পড়বে কি না তা আসলে নির্ভর করবে ওই সময়ে দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি কেমন থাকে, অর্থনীতি কতটা সুসংহত থাকে, তার ওপর।
আইএমএফের সাথে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আলোচনা হয়েছে এবং প্রাথমিক আশ্বাস পাওয়া গেছে। এই অর্থ নেয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ এই ঋণ মধ্যমেয়াদে অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। এতে বিদেশী বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগীরা এক ধরনের আস্থা পাবে। কারণ তারা মনে করবে, বাংলাদেশকে এক ধরনের পরিবীক্ষণ ও নজরদারিতে রাখছে আইএমএফ।
উপসংহার বলা যায়, ঋণ থেকে বাঁচার জন্য বিদেশী ঋণ গ্রহণ ও তা পরিশোধকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদন ও পরিবহন ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের ভিত্তিতে তৃতীয় পক্ষ কর্তৃক এলসি নিশ্চয়তার ফি কমানোর বিষয়েও উদ্যোগী হতে হবে। আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে আনা হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেন বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে প্রভাব না পড়ে, কারণ বিনিয়োগ কমে গেলে অর্থনীতি মন্দার দিকে ধাবিত হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার যৌক্তিক অবমূল্যায়নের বিষয়েও ভাবতে হবে; অন্যথায় হুন্ডি বেড়ে গিয়ে রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়বে। মেয়াদোত্তীর্ণ হতে যাওয়া বিদেশী ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষভাবে বলতে হয়, মেগা ঋণে নেয়া প্রকল্পের খুব কম প্রকল্প খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হয়ে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে যাচ্ছে। ফলে, বেশির ভাগ ঋণ পরিশোধই অন্য খাতের আয় থেকে করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রকল্প শেষ করে অর্থনীতিতে অবদান রাখার।
সর্বোপরি বলা যায়, দেশের ঋণ সঙ্কটের অন্যতম কারণ হলো দুর্নীতি। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বাভাবিক খরচের চেয়ে দুই-তিনগুণ অর্থ খরচ হওয়াটাই যেন এখন স্বাভাবিক। অন্তত বর্তমান সঙ্কটকালীন সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন যে অর্থ ছাড় হয়েছে সেই অর্থ ঠিকমতো ব্যবহৃত হয়। সর্বোপরি ভবিষ্যৎ ঋণের জন্য কোনো দেশ থেকে ঋণ নেয়ার চেয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ঋণের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ এই প্রতিষ্ঠানের ঋণগুলো হচ্ছে সস্তা, সহজ শর্তের। পাশাপাশি বর্তমান পাইপলাইনের ঋণের অর্থগুলো আরো দ্রæত ছাড় করানোর চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]