আ.লীগের ‘প্রীতি ম্যাচের’ ভীতি

আ.লীগের ‘প্রীতি ম্যাচের’ ভীতি

বিএনপিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেসব কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে, তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো দলের মনোনীত প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র, বিকল্প কিংবা ডামি প্রার্থীদের উৎসাহিত করা।

বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির ইতিহাসে এটা অভূতপূর্বই বলতে হবে। আগে কোনো আসনে মনোনীত কোনো প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের আশঙ্কা থাকলে বিকল্প প্রার্থী দাঁড় করানো হতো। এবার প্রায় সব আসনেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দাঁড়িয়ে গেছেন, যদিও ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখের পরই চূড়ান্ত তালিকা জানা যাবে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭(১১) ধারায় বলা আছে, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হলে সরাসরি বহিষ্কার হবেন। এমনকি প্রার্থী না হলেও কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করলে তদন্ত সাপেক্ষে বহিষ্কার হবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনেক ভেবেচিন্তে সেই প্রার্থীকেই মনোনীত করেছিল, যাঁর দক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের চেয়ে বেশি।

একাদশ জাতীয় সংসদের ৭১ জন সংসদ সদস্য মনোনয়ন পাননি, দলের মনোনয়ন বোর্ড যাঁদের যোগ্য মনে করেনি। অথচ তাঁদেরই আবার উৎসাহিত করা হচ্ছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করছে, নির্বাচনে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী যেসব দল প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে, তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। ফলে একতরফা ‘গোল’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এই নীতি বুমেরাংও হতে পারে। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে যদি একই দলের একাধিক প্রার্থী দাঁড় করানো হয়, তাহলে তো দলীয় শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না। অনেক স্থানে এর আলামতও শুরু হয়ে গেছে। সারা দেশের অসংখ্য ঘটনা থেকে এখানে দুটি উল্লেখ করছি:

এক. কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আবুল কালাম আজাদকে হুমকি দিয়ে উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক লিটন সরকার বলেন, ‘আবু কালাম বিষফোড়া হইলেও আমরার উপকার করে দিছে। এখানে আছে রাজী মোহাম্মদ ফখরুল (বর্তমান সংসদ সদস্য)। বাঘের থাবা থেকে বাঁচার ক্ষমতা আছে, কিন্তু রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের থাবা থেকে বাঁচার ক্ষমতা কারও নেই। রাজী মোহাম্মদ তো পরের বিষয়, তুই আগে আমরার থাবা থেকে বাঁচ! আমি ওপেন চ্যালেঞ্জ দিলাম। আরে কম্পিটিশন তো দূরের কথা, জামানত থাকত না।’

মঙ্গলবার দেবীদ্বার উপজেলার ভানী ইউনিয়ন যুবলীগের আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

আবুল কালাম আজাদ দলের মনোনয়ন চেয়ে পাননি। সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। লিটন সরকারের অনুসারীরা তাঁর এক সমর্থককে কুপিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রাথী। (প্রথম আলো, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩)

দুই. গত বুধবার দুপুরে মাধবদী পৌরসভা মিলনায়তনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুজ্জামান কামরুলের মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে সদর আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ওরফে হিরুর লোকজনের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘নৌকাওয়ালারা পালানোর জন্য জায়গা পাবে না।’ তাঁর দেওয়া এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা বদিউল আলমের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ২৯ নভেম্বর এই আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের এক মতবিনিময় সভায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হুমকি দিয়ে বক্তব্য দেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আহসানুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই। পোলাপাইনও জানে কীভাবে পিটাইতে হয়। কোনো স্বতন্ত্র-মতন্ত্র ছাত্রলীগ মানে না।’ নির্বাচনী আইন ভঙ্গের দায়ে আহসানুল ইসলাম এখন কারাগারে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র, বিকল্প কিংবা ডামি প্রার্থী দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের ভয়, বিএনপি নির্বাচন না করায় এবারও অনেক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন। ২০১৪ সালে বিএনপিহীন নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হন।

নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা। কিন্তু সেটি তো এক দলের ভেতরে হতে পারে না। সেটি হলে দলের কমিটি গঠনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের পার্থক্য থাকে না। নির্বাচন হয় নীতি–আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে। রাজনৈতিক দলও চলে নীতি–আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের সামনে হাজির হবে। নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করবে; যাতে গত পাঁচ বছরে তাদের সাফল্য ও কীর্তির পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও তুলে ধরা হবে।

আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা নিশ্চয়ই দলের নীতি–আদর্শ ও কর্মসূচি প্রচার করবেন। তাঁরা গায়ে মুজিব কোট ও বুকে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত ব্যাজ লাগাবেন। কিন্তু তাঁদের বিপরীতে দল যাঁদের স্বতন্ত্র, বিকল্প কিংবা ডামি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে, তাঁরা কী করবেন?

নির্বাচনী প্রচারের সময় কি তাঁরা বলবেন, নৌকা প্রতীক খুবই খারাপ। গত পাঁচ বছরে দেশে কোনো উন্নয়ন হয়নি, দুর্নীতি ও অপশাসন জেঁকে বসেছে? আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হিসেবে এসব কথা তিনি বলতে পারবেন না। তিনি দলের নীতি ও আদর্শের বাইরে যেতে পারবেন না। তাহলে তাঁকে নৌকার চড়নদারের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। তাঁকে বলতে হবে, ‘আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভুল প্রার্থীকে নৌকা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে আমারই নৌকা পাওয়ার কথা। আপনারা আমাকে ভোট দিন।’

মোদ্দাকথা, এবার নির্বাচনটি মোটেই নীতি–আদর্শের ভিত্তিতে হচ্ছে না। কোনো দল সরকারের ভুল অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবে, সে রকম কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের বাইরে ১৪ দলের শরিকেরাও নৌকার জন্য মুখিয়ে আছেন। শোনা যায়, জাতীয় পার্টির নেতারাও কিছু আসনে ‘নৌকা’ প্রত্যাহারের জন্য দেনদরবার করছেন। ১৪ দলের একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, নৌকা এখন ১৪ দলের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে কি তিনি তাঁর দলের আত্মবিলোপেরই ইঙ্গিত দিলেন না?

বিগত স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। অনেক স্থানে বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। কিন্তু এবার কেউ বিদ্রোহী থাকছেন না। তাঁরা কেউ দলের আদেশ–নির্দেশ লঙ্ঘন করছেন না। তাঁরা শীর্ষ নেতৃত্বের অভিপ্রায় অনুযায়ী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

নির্বাচনে সাধারণত সব দলই নিজের প্রতীককে জিতিয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কেননা, বাংলাদেশের মানুষ প্রার্থীর গুণাগুণ বিচারের চেয়ে দল ও প্রতীককে অধিক গুরুত্ব দেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমনভাবে নির্বাচনী কৌশল সাজিয়েছে, যাতে নিজ দলের নেতারাই দুই পক্ষ হয়ে লড়তে পারেন। একে প্রতিযোগিতা না বলে প্রীতি ম্যাচ বলা যেতে পারে। মাঠপর্যায় থেকে যেসব আলামত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে প্রীতি ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

প্রথম আলো