পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগেই আরেক দফা বেড়েছে বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম। এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। সেগুলো হলো ডলার-সংকট ও এর বাড়তি দাম, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট এবং উচ্চ শুল্ক।
তবে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের নিজেদের যে ‘দায়িত্ব-কর্তব্য’ রয়েছে সেটি স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, দিন শেষে একটা কথা আছে, ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করেন। তাঁর মতে, এই অতি মুনাফা ও মজুতদারি থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যবসায়ীদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা চারটি কারণের কথা তুলে ধরে বলেন, ডলারের যে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেই দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
বরং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ‘ইচ্ছেমতো’ ডলারের দাম নিচ্ছে। সে জন্য পণ্য আমদানিতে খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া পরিবহনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজির কারণে সবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। সিন্ডিকেটের কারণে ব্রয়লার ও গরুর মাংসের দাম কমছে না। উচ্চ শুল্কের কারণে আকাশচুম্বী হয়েছে চিনি ও খেজুরের দাম।
‘রমজানে নিত্যপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে’ এক মতবিনিময় সভায় নিত্যপণ্যের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সাধারণ ব্যবসায়ীরা এসব অভিযোগ করেন। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) এই সভার আয়োজন করে।
রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই আইকন ভবনে গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি মাহবুবুল আলম। এতে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বড় কোম্পানির প্রতিনিধি, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী, ঢাকার বিভিন্ন বাজার কমিটির নেতা, বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রতিযোগিতা কমিশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ব্যবসায়ী শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এখনই ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, পেঁয়াজসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে।
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এটা ঠিক আমরা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ব্যবসা করি। তবে আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে, বাজার ঠিক রাখতে হবে। কোনো ব্যবসায়ী পণ্যের বেশি দাম রাখবেন না। আপনারা রমজান মাসে ন্যায্য লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সতর্ক আছেন। তাই সবাইকে সাবধান হতে হবে।’
পণ্য পরিবহনের চাঁদাবাজি নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়ে মাহবুবুল আলম বলেন, পণ্য পরিবহন কিংবা ওঠানো-নামানোর সময় চাঁদাবাজি হলে জানাবেন। চাঁদাবাজদের ছাড় দেওয়া হবে না। দরকার হলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে কথা বলে এ সমস্যার সমাধান করা হবে।
ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসার ক্ষেত্রে এ দেশে কিছু চ্যালেঞ্জ সব সময়ই ছিল। এগুলো নতুন নয়। ব্যবসায়ীরা লোকসানে ব্যবসা করবেন, এটাও আমাদের চাওয়া নয়। আমরা বলেছি, মুনাফা করবেন, তবে সেটি যৌক্তিক হতে হবে। আর কৃত্রিমভাবে বাজারে কোনো সংকট তৈরি করা যাবে না।’
ব্যবসায়ীদের যত অভিযোগ
সভায় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, বাজারে কিছু পণ্যের দাম এরই মধ্যে বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস ও পেঁয়াজের দাম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান বলেন, গত ১৫ দিনে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকায় উঠে গেছে। আমাদের আশঙ্কা, রমজানে গতবারের মতো ২৫০-৩০০ টাকায় এই মুরগি কিনতে হবে। মসলার দামও বেড়েছে বলে অভিযোগ করেন ইমরান হাসান। তিনি বলেন, কয়েকজন ব্যবসায়ী মসলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। দয়া করে মসলা নিয়ে কোনো তেলেসমাতি করবেন না।
ইমরান হাসান আরও বলেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসার প্রধান উপকরণ পেঁয়াজ। তার দামও অনেক দিন ধরে বাড়তি। এই পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভর না থেকে অন্য দেশ থেকে আমদানির পরামর্শ দেন তিনি।
শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মাজেদ বলেন, ‘ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর আমরা সমস্যায় পড়ে গেছি। দাম কমাতে পারছি না। মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজ শেষ। হালি পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। তাতে রোজায় পেঁয়াজের দাম কমে আসবে।’
দাম কমাতে সরকারি সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির পরামর্শ দেন পেঁয়াজ আমদানিকারক হাফিজুর রহমান।
ব্রয়লার মুরগির দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে উৎপাদক ও আড়তদারদের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খন্দকার মনির আহমেদ। তিনি জানান, তাঁরা বর্তমানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৮৫ টাকা ও কক মুরগি ৩০০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করছেন।
কাপ্তান বাজারের ব্যবসায়ী নেতা আবদুল মান্নান খান অবশ্য ব্রয়লার মুরগির বাড়তি দামের জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, যাঁরা বলেন সিন্ডিকেট নেই, তাঁরা কাপ্তান বাজারে আসেন। রাতের বেলায় মুরগি আসে। ১০-১২ জন ব্যবসায়ীর একটি কমিটি নিজেদের মতো দাম নির্ধারণ করে। মুরগি কম এলে তাঁরা দাম বাড়িয়ে দেন।
আবদুল মান্নান খানের এই বক্তব্যের পর এফবিসিসিআই সভাপতি সব পাইকারি বাজারে মূল্যতালিকা টাঙাতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, মূল্যতালিকায় পণ্যের দাম, বিক্রেতার নাম-ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে।
উচ্চ শুল্কের কারণে এ বছর খেজুরের দাম গতবারের চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ বেড়েছে—সভায় এমন অভিযোগ করেন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। তাঁর মতে, সবাই সহযোগিতা না করলে খেজুরের দাম নাগালে রাখা যাবে না। সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা ঋণপত্র খুলতে পারছি না। বাংলাদেশ ব্যাংক ১১০ টাকা ডলারের দাম নির্ধারণ করেছে। অথচ আমাদের ১২৩-১২৫ টাকা দিতে হচ্ছে। ১ কেজি খেজুর ১১০ টাকায় কিনলেও শুল্ক দিতে হচ্ছে ১৪০ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।’
চিনির শুল্ক নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা। তিনি বলেন, প্রতি কেজি চিনি আমদানিতে ৪৩ টাকা শুল্ক ও কর দিতে হয়। অথচ ভারতে ৪০ রুপিতে চিনি কেনা যায়। এ ছাড়া অন্যায়ভাবে কোনো ব্যবসায়ীকে মজুতদার বললে মামলা করবেন বলেও তিনি সভায় জানান।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি কাঁচামাল ব্যবসায়ীদের নেতা সাইফুর রহমানের অভিযোগ, পথে পথে চাঁদাবাজি ও আড়তের বাইরে পণ্য কেনাবেচা নিয়ে। তিনি বলেন, কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন তিন লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ কেজি আলু এবং দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ কেজি পেঁয়াজ কেনাবেচা হয়। পথে পথে চাঁদাবাজির কারণে ট্রাকভাড়া বেড়ে যায়, বাড়ে সবজির দামও।
সভায় উপস্থিত এস আলম, সিটি, মেঘনা, দেশবন্ধুর মতো বড় শিল্পগোষ্ঠীর কর্মকর্তারা বলেন, ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলাসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত জোগান রয়েছে। রোজার সময় এসব পণ্যের কোনো রকম সংকট হবে না।
ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অভিযোগ ও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানের দেশের অর্থনীতিতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি নেই। এই মুহূর্তে ডলার–সংকট নিরসন ও শুল্ক কমানো কঠিন। তবে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট বন্ধ তুলনামূলক সহজ। চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবসায়ীদের জোরালো অবস্থান নিতে হবে। স্থানীয় বাণিজ্য সংগঠনগুলোর মাধ্যমে চাঁদাবাজির তথ্য সংগ্রহ করে তা সরকারের কাছে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। আর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আইন সংস্কার করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উৎপাদন এবং পণ্য সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। একচেটিয়া ব্যবসা ভাঙতে পারলেই সিন্ডিকেট কমবে।
prothom alo