মূলধন ঘাটতি পূরণে সহায়ক নয় ২৪ ব্যাংকের কর্মপরিকল্পনা!

রোহান রাজিব: ব্যাংক খাতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝুঁকিনির্ভর সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে। কিন্তু নিয়ম মেনে ২৪টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন, ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি) ও লিভারেজ রেশিও সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। তাই মূলধন ঘাটতি পূরণ, সিসিবি সংরক্ষণ ও লিভারেজ রেশিও ন্যূনতম পর্যায়ে উন্নীতির লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে কর্মপরিকল্পনা চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মাসের ১ তারিখে এ কর্মপরিকল্পনা চেয়ে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে চিঠি দেয়া হয়।

তবে ব্যাংকগুলোর এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যেসব কর্মপরিকল্পনা বা পদক্ষেপ নেয়ার কথা বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তা স্বল্প কিংবা মধ্য মেয়াদি সময়ের জন্য সহায়ক নয়। একই সঙ্গে এসব পদক্ষেপ থেকে ফলাফল পাওয়া যাবে না। বরং এসব ব্যাংকের পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মতামত দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম চালানোর জন্য এমসিআর ও সিসিবি থাকতে হবে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও আড়াই শতাংশ হারে। এছাড়া এলআর ৩ শতাংশে। তবে গত জুন প্রান্তিকে ১৯টি ব্যাংক এ ধরনের ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে। আর ৫টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নিয়মের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।

জানা যায়, সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, জনতা, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক এবং পদ্ম ব্যাংক এমসিআর, সিসিবি ও এলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।

এসব ব্যাংক কর্মপরিকল্পনাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে জানায়, খেলাপি ঋণের হার হ্রাস, খেলাপি ও অবলোপন ঋণ থেকে আদায় বৃদ্ধি, পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধি এবং নিট সুদ আয় বৃদ্ধি, ব্যাংকের সুদ আয় বৃদ্ধি, প্রভিশন ঘাটতি হ্রাস, জামানত বৃদ্ধিসহ ঋণ বিতরণ, ভালো রেটিং মান সম্পন্ন ঋণগ্রহীতার অনুক‚লে ঋণ বিতরণ, সরকারি ও এসএমই খাতে ঋণ বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং কস্ট অব ফান্ড কমিয়ে আনার মাধ্যমে বিদ্যমান মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হবে। আর আইসিবি ইসলামি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক আইনি জটিলতার কারণে মূলধন ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয় বলে তাদের কর্মপরিকল্পনাতে জানানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তরা জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর এ সমস্যা নতুন নয়, বছরের পর বছর ধরে এ ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি খারাপ। প্রতি তিন মাস পর পরই ব্যাংকগুলো থেকে কর্মপরিকল্পনা চাওয়া হয়। তবে এসব কর্মপরিকল্পনা দেয়ার জন্যই দেয়। কারণ এখন পর্যন্ত তাদের কর্মপরিকল্পনা থেকে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। বরং দিন দিন তাদের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।

অপরদিকে ন্যাশনাল ব্যাংক এমসিআর ও সিসিবি এবং সলো ভিত্তিতে সিসিবি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় আইএফআইসি ব্যাংক। সলো কনসোলিডেটেড ভিত্তিতে সিসিবি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক।

এক্ষেত্রে ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক কর্মপরিকল্পনায় জানায়, সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু, খেলাপির বিপরীতে আদায় বৃদ্ধি, কম সুদে আমানত বৃদ্ধি, পরিচালন ব্যয় ও আমানত ব্যয় কমিয়ে মুনাফা বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি কমিয়ে আনবে। তবে ব্যাংক দুইটির মূলধন ঘাটতির পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলেও স্বল্পমেয়াদে বিদ্যমান মূলধন ঘাটতি পূরণসহ সিসিবি ন্যূনতম রাখার সীমায় উন্নতি করার সম্ভব হবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মতামত দিয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোর কর্মপরিকল্পনা পরবর্তী দুই প্রান্তিক পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টর পর্যবেক্ষণে রাখতে বলা হয়।

এছাড়া ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মূলধন ও পরিশোধিত মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, হাবিব ব্যাংক এবং সীমান্ত ব্যাংক। এসব ব্যাংক মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন ৪০০ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীতি করার কারণে ঘাটতিতে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

মূলধন ঘাটতি উত্তরণের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটা উদ্বেগজনক অবস্থা, ব্যাংক খাত যে খারাপের দিকে যাচ্ছে, মূলধন ঘাটতির চিত্র তা-ই বলে দিচ্ছে। খেলাপি ঋণ বাড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূলধন ঘাটতি কমাতে হলে পলিসি অনুযায়ী এগোতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য এক পলিসি হবে, যা পালন করবে সরকার। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো দায়িত্ব নেবে তাদের পর্ষদ। যেসব ব্যাংক নীতি অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না তাদের দুর্বল ব্যাংক হিসেবে একীভ‚ত করে দিতে হবে। তা না হলে বছরের পর বছর ঘাটতি বাড়তেই থাকবে।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ রেকর্ড ১৫টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া প্রান্তিকে এই ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি ছিল ৩৩ হাজার ৭৪৪ কোটি, যা ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা। এর আগে ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে সর্বোচ্চ ৩৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতির ঘটনা ঘটেছিল।

জুন পর্যন্ত ১৫টি ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। এ খাতে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ছিল ২ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি অগ্রণী ব্যাংকের। জুন শেষে এ ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৩৫২ কোটি, জনতা ব্যাংকের ২ হাজার ১৮৯ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ২ হাজার ২৩০ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকের ১১ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ঘাটতি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ৩৮০ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ৩১৪ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের ৪৯৭ কোটি, সিটিজেন ৯৭ কোটি এবং বেঙ্গল ব্যাংকের ৮৮ কোটি টাকা ঘাটতি দাঁড়ায়। অন্যদিকে বিদেশি দুটি ব্যাংকও মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এ খাতের হাবিব ব্যাংকের ঘাটতি ৩৬ কোটি এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৪২ কোটি টাকা।

এদিকে গত জুন শেষে ঘাটতি থাকা ব্যাংকের মধ্যে ৫টি ব্যাংকের মূলধন ভিত্তির অনুপাত (সিএআর) ঋণাত্মক ধারায় নেমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসিক ব্যাংকের (সিএআর) ঋণাত্মক দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১৪৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৪৭ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ সিএআর ঋণাত্মক রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, তিন কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এক. যেসব ব্যাংক লোকসান করেছে তারা মূলধন ঘাটতিতে পড়তে হয়েছে। দ্বিতীয়ত. কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে প্রভিশন রাখতে পারে না। তাই এ ধরনের ব্যাংকও মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে। তৃতীয়ত. বাংলাদেশ ব্যাংক ৪০০ কোটি থেকে মূলধন ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করায় কিছু ব্যাংক নতুন করে ঘাটতিতে পড়েছে। তাই মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকের সংখ্যাও বেড়েছে।

শেয়ার বিজ