বিশেষ প্রতিনিধি
সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ইসলাম পন্থিদের ঘাড় মটকে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন সপ্তাহ খানে আগে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আ ক ম মোজাস্মেল হক দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরামকে ‘অর্বাচিন’ আখ্যায়িত করে একদিন আগে বলেছেন, কোন ‘অর্বাচিনের’ কথায ভাস্কর্যের নামে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি স্থাপন বন্ধ হবে না। সরকারের এই দুই মন্ত্রীর উস্কানিমূলক বক্তব্যের পরই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জীবনী নিয়ে বৃহস্পতিবার আয়োজিত সিরাত সম্মেলন বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। অথচ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে দেশব্যাপি আয়োজিত সমাবেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক শ্লোগান দেয়া হয়েছে সম্প্রতি। নির্বিঘ্নে তারা রাজপথে শ্লোগান দিয়ে ‘কুরুক্ষেত্রের’ সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে। তাদের কিছুই বলা না হলেও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জীবনী নিয়ে আলোচনা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে সরকারের যত আপত্তি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সষ্টিটিউট মিলনায়তনে এই সীরাত সম্মেলন ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। একেবারে অন্তিম মুহূর্তে পুলিশ এসে সম্মেলন স্থলের গেইটে তালা লাগিয়ে দেয়।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মূর্তি তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় এইসব মূর্তি স্থাপনের প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ সমাবেশ হয় সম্প্রতি। এই সমাবেশ থেকে ওলামায়ে কেরাম মূর্তি স্থাপন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। নতুবা আন্দোলনের হুশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এরপরই শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত উপমন্ত্রী নওফেল গত ১৪ নভেম্বর শ্যামাপূজা উপলক্ষে চট্টগ্রাম নগরীর গোলপাহাড় মহাশ্মশান পরিচালনা পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতাদের উদ্দেশ্য হুমকি দিয়ে বলেন, ‘যতটুকু বলেছেন ক্ষমা চেয়ে সাবধান হয়ে যান। বাড়াবাড়ি করলে ঘাড় মটকে দেবো।’
১৯ নভেম্বর (বুধবার) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মূর্তি স্থাপনে বিরোধীতা করে বক্তব্যদানকারী ওলামায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে বলেন-‘কোন অর্বাচিনের কথায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মান বন্ধ হবে না।’ একই অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন-‘সারা দেশে জাতির জনকের অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মান করা হয়েছে। পথে ঘাটে কে কি বলল, তা নিয়ে গুরুত্ব দেয়ার কোন কারণ নেই।’
আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রতিমন্ত্রীর এই কথা বলার একদিনের মাথায় বন্ধ করে দেয়া হয় সীরাত সম্মেলন।
হেফাজতে ইসলামর একজন নেতা বলেন, অলিতে-গলিতে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপনের প্রতিবাদ করায় তাদের বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ নিলো সরকার।
সীরাত সম্মেলনে প্রশাসনের বাধার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে খেলাফত মজলিশের মহাসচিব ড. আহমদ আবদু কাদের বলেন ‘এটা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিলো না। সরকারবিরোধী কর্মসূচী তো নয়ই। তবুও বাধা দেয়া হয়েছে। এই ঘটনাটা দুঃজনক এবং আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। সরকার এ ধরণের অনুষ্ঠানে বাধা দিয়ে অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা করায় সরকার পাল্টা জবাব হিসেবে এটা করতে পারে। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। তবে একজন ভাল মুসলমান কখনোই মূর্তির পক্ষে কথা বলতে পারে না-সমর্থনও করবে না। আমরাও করি না-করবো না।’
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রহমাতুল্লিল আলামীন ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সেবা সংস্থার উদ্যোগে রাজধানীর রমনাস্থ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ ও রহমাতুল্লিল আলামীন কনফারেন্স (সীরাত সম্মেলন) এর আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর আমির আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী প্রধান অতিথি ও হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমীসহ সিনিয়র ওলামায়ে কেরামদের বক্তব্য রাখার কথা ছিল। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে পুলিশ এসে সেটি বন্ধ করে দেয়।
নাচ গানের অনুষ্ঠানে পুলিশ প্রহরায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেও, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী নিয়ে আয়োজিত পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান বাতিল করে ইসলামের বিরুদ্ধেই সরকার অবস্থান নিলো বলে মন্তব্য করেন আয়োজকদের কয়েকজন।
তারা বলেন, সারা দেশে ইচ্ছামাফিক বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপনের প্রতিবাদ করায় এরই মধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও ফোন করে তাদের ওপর চাপ শুরু হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানান, রাষ্ট্রীয় একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা থেকে হেফাজত নেতাদেরকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
সীরাত সম্মেলন বাতিল করায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ। তারা বলেন, পুলিশ দিয়ে ভয় দেখিয়ে সীরাতুন্নবী সম্মেলন বন্ধ করা নবীপ্রেমিক জনতাকে বিস্মিত ও মর্মাহত করেছে। এ ধরণের ঘটনায় সরকারের ইসলাম বিদ্বেষী চরিত্রই ফুটে উঠছে। সারাদেশে কোরআনের তাফসীর মাহফিল বন্ধের ষড়যন্ত্র মুসলিম জনতা বরদাশত করবে না।
সিরাত মাহফিল অয়োজক সংগঠনের আহবায়ক মুফতী সাখাওয়াত হেুসাইন রাজী জানান, যথাযথ নিয়ম মেনেই আমরা ইঞ্জিনিয়ারর্স ইন্সটিটিউশনের মিলনায়তন ভাড়া করেছিলাম। কিন্ত পুলিশ এসে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের গেইটে তালা লাগিয়ে দেয়। সেখানে আগত আয়োজক ও নেতা-কর্মীদেরকে প্রবেশ করতে না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। পরে আগত শত শত মাদরাসার ছাত্র ও ওলামায়ে কেরাম রমনা থেকে মিছিল করে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেইটে প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হয়।
সীরাম মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নবনির্বাচিত আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বৃহস্পতিবার বাদ আসর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদ প্রাঙ্গণে এক সমাবেশে বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। হেফাজতে ইসলাম সরকার বিরোধী আন্দোলনও নয়, আবার সরকারদলীয় আন্দোলনও নয়। আমরা কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য আসিনি। আমরা এসেছি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। হেফাজতে ইসলামের এজেন্ডাই এটা। ইসলাম ও মুসলমানদের ঈমান, আক্বিদার ওপর আঘাত আসলে হেফাজতে ইসলাম সেটা প্রতিহত করতে প্রস্তুত রয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ইসলাম বিরোধী কোন কার্যকলাপ ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে ঈমানদার জনগণ মেনে নেবে না। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে মানুষকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যায় না। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও দেশে স্বাধীনতার ওপর আঘাত আসলে হেফাজতে ইসলাম জনগণকে সাথে নিয়ে সেটা প্রতিহত করবে।
সরকার প্রধানের উদ্দেশ্যে আল্লামা বাবুনগরী বলেন, সিরাতুন্নাবী (সা.) প্রোগ্রামে বাধা দিয়ে আপনি নিজে বিপদে পড়বেন না। আমাদের জনগনের ও তৌহিদী জনতার মনোভাব বুঝতে হবে আপনাকে। দাবি-দাওয়া বুঝতে হবে। আমরা আপনার সচিবালয় দখল করার জন্য কিংবা ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার জন্য আন্দোলন করছি না। ওলামায়ে হকের কাছে এই জাতীয় সংসদের কোনো দামই নেই, কোনো মূল্যই নেই। ওলামায়ে হকের সামনে কোরআন শরীফ আছে, বোখারী শরীফ আছে। ওলামায়ে হকের কাছে কোরআন শরীফ, বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ এর দাম দুনিয়ার ক্ষমতার চেয়ে কোটি গুণ বেশি। ইসলামের শত্রুদের খুশি করতেই সীরাত সম্মেলন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কেউ ক্ষমতায় টিকতে পারে না।