মুখোশ মানুষ ও আমাদের সমাজ

  • জাকির আবু জাফর
  •  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:২১

মুখোশ মানুষ ও আমাদের সমাজ – ফাইল ছবি

টুকরো টুকরো ক’টি গল্প দিয়েই শুরু করি। গল্পের ভেতর দিব্যি স্বচ্ছ হবে মুখোশ পরা মানুষের মুখ। স্বচ্ছ হবে- খলনায়ক কেমন করে নায়ক সেজে শির উঁচু করে দাবড়াচ্ছে সর্বত্র! ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের চার পাশ, রাজপথে এবং আমাদের সুশীল পাড়ায়। বাইরে সৎ, ভেতরে চরম অসৎ! দেখে মনে হয় দরবেশ, বাস্তবে শয়তানের চরিত্র! এমনই মানুষ নামের অমানুষে ভরা সমাজের বুক।
প্রথম গল্পটি একজন সমাজসেবকের। তার দাবি, তিনি সমাজের গরিব দুঃখীর মুখে এক টুকরো সুখের হাসি ফোটাতে ব্যস্ত। সারা দিন এমনকি কখনো কখনো সারা রাতও ব্যস্ততার ঘোরে কেটে যায়। মানুষের কাছে তিনি বিরাট সেবক। সমাজসেবক হিসেবে তিনি বিশেষ সম্মানের অধিকারী। এক নামে সবাই চেনেন তাকে। এ নিয়ে তার গর্বেরও শেষ নেই। অহঙ্কারের বাতাস জামায় জড়িয়ে বিচরণ করেন তিনি। যেখানে যান, দেখার আগেই হাত উঁচু করে রাখে মানুষ। যেন চোখ পড়লেই সম্মান দেখানো যায়। কাছাকাছির আগেই গলার জোর খাটিয়ে সালাম এবং অভিবাদন জানায়। এতে ভীষণ পরিতৃপ্তি পান এই সমাজসেবক।

একদিন একটি গরিব পরিবারে সাহায্য দিলেন তিনি। দিলেন পাঁচ হাজার টাকা। সঙ্গে একটি কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে গরিব লোকটিকে বললেন- এখানে একটি স্বাক্ষর দিয়ে দাও।

গরিব লোকটি নিরক্ষর নন। মোটা দাগে কিছুটা অক্ষর জ্ঞান আছে তার। পড়তে পারেন কিছুটা। দেখলেন- পাঁচ হাজার টাকার ঘরে অঙ্কটি পঞ্চাশ হাজার টাকার! চমকে উঠলেন লোকটি! একবার দুবার বারবার দেখলেন। না ঠিকই তো দেখছেন! অঙ্কটি পঞ্চাশ হাজারের। বললেন- না, স্যার এইডা হতে পারে না। পাঁচ দিয়ে পঞ্চাশ কি করে হয়! ভীষণ চটে গেলেন সমাজসেবক। গরিব লোকটির গায়ে হাত তুলতেও বাধল না তার।

দ্বিতীয় গল্পটি একজন দানবীরের। তিনি উচ্চকণ্ঠে প্রচার করেন- কেউ কিছু চেয়ে তার কাছ থেকে খালি হাতে ফেরে না। অকাতরে দান করেন তিনি। তাই তার পরিচয় ‘দানবীর’। তার উপস্থিতি সবাইকে উৎসাহিত করে। সবাই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় তাকে। সবাই সম্মান জানিয়ে প্রকাশ করে তার মহত্ত্ব! তিনিও আনন্দে গদগদ। মুখে সারাক্ষণ লেগে থাকে হাসির রেশ। কেউ সাহায্য প্রার্থী হলেই তিনি আয়োজন করেই সাহায্য করেন। ছবি তোলেন। ফেসবুকে ফলাও করেন। পাঁচশ’ টাকার সাহায্যে পাঁচ হাজার টাকার প্রচার। সবার ধারণা, তার কাছে চাইলেই তিনি দেন। আহা! কত কত ভালো মানুষ তিনি- এমনই সুনাম চারি দিকে।

একটি অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি। অতিথি মানে প্রধান অতিথি। তিনি এলেন। গাল ভরা হাসির উচ্ছ্বাস। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। তার সম্মানে দাঁড়িয়ে গেল গোটা মজলিস। সবাই তাজিম করল তাকে। অতি উৎসাহী জনতা স্লোগানও ধরলেন। স্লোগান শুনে ভীষণ আপ্লুত তিনি। আনন্দের উত্তাপ মুখে। হাসির চোটে ঠোঁট দুটো যেন কান পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল!

আরো আরো অতিথিদের বক্তব্য শেষ। এবার প্রধান অতিথির পালা। অনুষ্ঠান উপস্থাপক তার ঘটে থাকা সব বিশেষণ দিয়ে নাম ঘোষণা করলেন। কিন্তু ‘দানবীর’ শব্দটি বলতে ভুলে গেলেন। ব্যস, আর যায় কোথায়! রাগে ক্ষোভে চোখ মুখ লাল হয়ে গেল দানবীরের! গায়ের সব জোর গলায় তুলে বললেন- এই মূর্খ উপস্থাপককে বের করে দাও এখান থেকে। নইলে আমি বেরিয়ে যাবো। বললেন, আমার চেয়ে বড় দানবীর কে আছে! আমার নাম যশ কি মনে লয় না ওর!

অপমানে অপদস্থ উপস্থাপক চোখের অশ্রু ফেলে বেরিয়ে গেলেন।
তৃতীয় গল্পটি একজন ধর্ম প্রচারকের। তিনি মানুষকে মহান রবের দিকে আহ্বান করেন। ভালো কাজের উপদেশ দেন। সততার জীবনযাপনের কথা বলেন। সত্য বলার নসিহত করেন। বিপথগামী মানুষের জন্য তিনি আফসোস করেন। কথায় কথায় বলেন- এ সমাজ দূষিত সমাজ। একে সুন্দর সমাজে রূপান্তরিত করতে হবে। সবাই যেন সত্যবাদী হয়, সত্য চর্চা করে তার বিষয়ে তিনি উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু তিনি তার বাস্তব জীবনে খুব সহজে মিথ্যা বলেন। কারণে তো বলেনই। অকারণ মিথ্যাও বলেন।

কেউ যদি ধরিয়ে দেন, আপনার এ কথাটি তো সত্য নয়। কেনো বললেন এটি? জবাবে বলেন- এটি কৌশল! কৌশল! মিথ্যা আর কৌশল দুটো কি এক? অবশ্যই না। মিথ্যা যেমনই হোক সে মিথ্যা-ই। কৌশল হলো, সত্যকে ঘিরে বুদ্ধিবৃত্তিক আয়োজন। আর মিথ্যা- যার কোনো অস্তিত্ব নেই। কিংবা যা ঘটে তার উল্টোটাই মিথ্যা।
তো এই যে ধর্ম প্রচারকের মিথ্যা বলাটি বিষয়টি বিস্ময়ের! তিনি কৌশল হিসেবে যেটির চর্চা করছেন তা কোনোভাবেই সততার সাথে যায় না। কাউকে সৎ থাকার নসিহত করা আর নিজে সৎ থাকা এক কথা নয়। মিথ্যাকে কৌশল হিসেবে যিনি গ্রহণ করেন- কোনো বিশেষ পদক্ষেপে তিনি ন্যায় অন্যায় বিবেচনা করতে পারেন না। জিজ্ঞেস করলে জবাব দেন- সময় পরিস্থিতির আলোকে কৌশল নিতে হয়। অর্থাৎ সত্য না বলা কৌশল। আবার অন্যায় আচরণও কৌশল!

চতুর্থ গল্পটি একজন রাজনীতিকের। তিনি বড় রাজনীতিক। সমাজে তার বেদম নাম ডাক। একনামে সবাই চেনে তাকে। তার অনেক ক্ষমতা। তিনি যখন যা চান তা-ই হয়ে যায়। যেভাবে চান, সেভাবেই হয়। তিনি চাইতে দেরি, ঘটতে দেরি হয় না। তার আশপাশের লোকেরা চলে তার চোখের ইশারায়। তিনি আ উচ্চারণ করলেই ‘আম’ বুঝে ফেলেন সঙ্গীরা। এসব ছাপিয়ে তার বড় পরিচয়- তিনি যা করেন জনগণের জন্য করেন। তার রাজনীতি কেবলই জনগণের জন্য। তো বেশ ভালো কথা। জননেতা জনগণের রাজনীতিই তো করবেন। কাজও করবেন জনগণের পক্ষে। খুব স্বাভাবিক এটি। কিন্তু কোনো সুযোগ এলেই বেরিয়ে পড়ে তার ভেতর জগৎ। তিনি হয়ে ওঠেন চূড়ান্ত সুবিধাভোগী। জনগণের জন্য ছয় আনা, আর নিজের জন্য দশ আনা- এটিই তার বণ্টনের নীতি! চতুর্দিকের সব বৈধ অবৈধ সুবিধার মিছিল তার দরোজার দিকে। তাকে ঘিরেই বয়ে যায় সব সুযোগের নদী। জনকল্যাণের নামে নিজের কল্যাণই তার কৌশল।

পঞ্চম গল্পটি একজন সাংবাদিকের। বড়সড় সাংবাদিক। যাকে বলে ডাকসাঁইটে। শিক্ষিতজনেরা চেনেনই। কম শিক্ষিতরাও চেনেন। অশিক্ষিতরা বলেন- ‘তিনি সাংবাদিক’। সভা সমাবেশে তার উপস্থিতি বেশ। চ্যানেলে টকশোতে তার নীতিকথার খই ফোটে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিটি বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ তার। অন্যের বিষয়ে শুধু সমালোচনা নয় বিষোদগারেও অভ্যস্ত। ঘটন অঘটনে রাতারাতি মন্তব্য দিতে পারদর্শী। দেখে মনে হয়- আহা, কতনা বিবেকবান সাংবাদিক!
কিন্তু তিনি প্রতিটি সত্য ঘটনাকে মিথ্যার কালো পর্দায় ঢেকে দেবার কাজটি বেশ যোগ্যতার সাথেই করেন। যা ঘটে তা গোপন করেন। অঘটনকেই ঘটনা বলে চালিয়ে দেন। তার হাত একটি থাকে উপরে একটি নিচে। ‘সুবিধাবাদ জিন্দাবাদ’ এটিই তার প্রধান নীতি। দোষীকে নির্দোষ সাজানোর কৌশলে পারদর্শী! নির্দোষকে দোষী সাব্যস্ত করার ভয়ঙ্কর খেলায় তার জুড়ি নেই!
আধুনিক বিশ্বে তো বটেই, প্রাচীন বিশ্বেও মানুষের জন্য সমাজবদ্ধতা ছিল অবধারিত। নিজেদের প্রয়োজন এবং আয়োজনেই সমাজের শেকলে বন্দী হয়েছে মানুষ!

সমাজে মানুষ নিজেরা নিজেদের জন্য তৈরি করেছে আইনের হাত। সমাজে আইনের এই হাত বড়ই শক্তিশালী। যে ব্যক্তি সমাজের আইন ভঙ্গ করবে, তার ওপর আইনের এই হাত উত্থিত হবে। আইনের এই হাত চেপে ধরবে অন্যায়কারীর হাত। কিন্তু আমাদের সমাজ কি অন্যায়কারীর হাত চেপে ধরে! ধরতে পারে! নাকি ধরার ইচ্ছে রাখে?
একটি সমাজে থাকে কিছু নিয়ম। কিছু অধিকার। কিছু পদ্ধতি। কিছু নীতি। কিছু সংস্কৃতি। এসব মান্য করতে হয় সমাজের সবাইকে। মেনেই করতে হয় কাজ। আমাদের সমাজে এসব মান্য করে কেউ? জবাব তো একটাই- না, মান্য করে না।
সমাজ থেকে কী আশা করে মানুষ? আশা করে, ব্যক্তি জীবনের একটি চমৎকার নিরাপত্তা। বসবাসের নিরাপত্তা। জীবনের নিরাপত্তা। পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা। কাজ কর্মের স্বাধীনতা। ধর্মীয় স্বাধীনতা।

আমাদের সমাজ এখন কোথায়! আমরাই বা সমাজের কোথায়! এসব ভাবতে গেলেই তালগোল পাকিয়ে ওঠে। কপালে ওঠে চোখ। চার পাশেই ভদ্রবেশী মুখোশ পরা মানুষের ভিড়। সবাই খোলস জড়িয়ে ছুটছে। খোলস ছাড়িয়ে ওঠা লোকের সংখ্যা নেহায়েতই কম।
কেউ তার নিজের জায়গায় নেই। ভেতর বাহির আলাদা। কথা ও কাজের অমিল। যা বলে তা করে না। যা করে তা বলে না। অথচ প্রতিটি মুখই ভাজে নীতির খই। এসব ভাজাভাজির মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য মানুষ! অথচ চিন্তা কথা ও কাজকে এক রেখায় আনাই মানুষের কাজ। চিন্তার সাথে কথা, কথার সাথে কাজের মিল না হলে কখনো মানুষ মানুষ হতে পারে না। আমাদের সমাজে আছে কি তেমন মানুষ!

লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক