বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে (ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২: ৪৮) লিখেছেন, ‘সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি…। তবুও ওরা [বাঙ্গালি জাতি] গরিব, কারণ যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যত দিন চিনবে না এবং বুঝবে না তত দিন এদের মুক্তি আসবে না।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখালেখি, বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে মুক্তি কথাটা ব্যবহার করেছেন প্রথমত রাজনৈতিক মুক্তি অর্থাৎ স্বাধীনতা এবং দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সমষ্টিগত বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর সম্ভাবনা হিসেবে, যাকে ইংরেজিতে ‘ইমানসিপেশন’ বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন সব জাতির পক্ষে সম্ভব হয় না। পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে অনেক জাতি এখনো নিজেদের ভূখণ্ডের মালিকানা পায়নি, অনেক অঞ্চল সেই মালিকানা পেয়েও হারিয়েছে। তাদের পক্ষে অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তিলাভের সম্ভাবনাটাও সে জন্য দূরবর্তী থেকে যায়। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে ইউরোপীয় নানা শক্তি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল, গত শতাব্দীর ষাট থেকে সত্তর দশকের মধ্যে সেসব অঞ্চলের উপনিবেশ মুক্তি ঘটেছিল।
সদ্য স্বাধীন প্রতিটি দেশ কল্পনা করেছে, রাজনৈতিক স্বাধীনতার হাত ধরে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের মুক্তি নিশ্চিত হবে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন এমন এক অশুভ কৌশল যে মাটির গভীরে ছড়ানো এর শিকড় কখনো উপড়ে ফেলা যায় না। ঔপনিবেশিক শাসন সময় ও সুযোগ অনুযায়ী নানা রূপ ধরে আসে। এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে পুঁজির শাসন, যার একটি প্রকাশ গোলকায়ন এক নতুন ঔপনিবেশিক কৌশল হিসেবে সক্রিয়। পশ্চিমের বাজারব্যবস্থা আমাদের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, পশ্চিমের সামরিক-শিল্প বাণিজ্যিক যৌগ আমাদের বহির্বাণিজ্য থেকে নিয়ে প্রতিরক্ষা, সব বিষয় তদারক করে। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও যোগাযোগের মতো অঞ্চলেও আমরা নয়া ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রভাব প্রতিনিয়ত অনুভব করি।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের সঙ্গে এক উদ্ভট ভৌগোলিক সংযোগে যুক্ত হয়েও পূর্ব বাংলার মানুষ আশা করেছিল, ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের নিকৃষ্ট চর্চাগুলো থেকে তাদের মুক্তি ঘটবে; একটি গণতান্ত্রিক, সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা পাবে, যা তাদের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যকে সম্মান জানাবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল, পুরোনো এক উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ পড়েছে এক নতুন ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে, যা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে অধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভাষা আন্দোলন থেকেই এই নতুন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হলো। ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার শপথ ছিল আত্মপরিচয় ও আত্মশক্তি বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পর্যায়।
৭ মার্চ এলে আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি নিয়ে অনেক কথা বলি, এর ভাষাগত বিশ্লেষণ থেকে নিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি, কিন্তু তিনি যে মুক্তির সংগ্রাম শুরুর কথাও বলেছিলেন, সে কথা ভুলে যাই অথবা মুক্তিকে স্বাধীনতার প্রতিশব্দ বিবেচনা করে একটি অর্থেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতার শেষে ‘ইমানসিপেশন’-এর কথাই বলেছিলেন। সেই মুক্তির সংগ্রাম যদি সত্যিকার অর্থে পরিচালিত না হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর ভাষায় বলতে হয়, ‘দেশের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।’
এরপর ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগকে রাজনীতির মঞ্চ থেকে বিদায় দিয়ে বাঙালি তার নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে শুরু করল। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর ছয় দফা আন্দোলনের সূচনা করলেন, পাকিস্তানিরা বুঝে নিল এবার অর্থনীতি থেকে নিয়ে বহির্বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রে বাঙালি তার নিজের ব্যবস্থাপত্রের প্রয়োগ ঘটাবে। বাঙালির রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য পাকিস্তান সামরিক শাসনের আশ্রয় নিল, ছয় দফার আন্দোলন থামাতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করল। কিন্তু যে জাতি তার সক্ষমতাগুলো সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত, তাকে কোনো কৌশলে দমন করা যে সম্ভব নয়, তা তারা বুঝতে অপারগ ছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির রাজনীতি শুধু পূর্ব বাংলা নয়, পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য তৈরি ছিল। এর উত্তর হিসেবে পাকিস্তানিরা যে কৌশল তৈরি করল, তার নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট; ২৫ মার্চ রাতে যার প্রয়োগ শুরু হলো।
২.
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন, তার কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রধান উদ্দেশ্যটি ছিল স্বাধীনতার জন্য আমাদের দাবিটি দেশের সব মানুষ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরা; স্বাধীনতা অর্জনে আমরা যে সক্ষম, সে সম্পর্কে পাকিস্তানি শাসকদের জানিয়ে দেওয়া, স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য মানুষকে প্রস্তুত করা এবং কীভাবে তা সম্ভব, সে সম্পর্কে অগ্রিম একটি ধারণা দেওয়া। ভাষণটি ছিল সংক্ষিপ্ত এবং এটি মন দিয়ে শুনলে (অথবা পড়লে) দেখা যাবে, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের একটি পূর্বাপর রূপ তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। শোষণ, বঞ্চনা, অধিকারহীনতা; শাসকদের নির্মমতা এবং হঠকারিতা ও নিজেদের প্রভুজ্ঞান করার বিষয়টি তিনি জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথাও ঘোষণা করেছেন এবং বক্তৃতার শেষে এসে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যদি নিষ্পেষণ চলে, প্রতি-আক্রমণে আমরাও প্রস্তুত। বক্তৃতাটিতে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি আলোচনায় প্রস্তুত, কিন্তু একই সঙ্গে এই ইঙ্গিতও দিয়েছেন, এই পাকিস্তানিরা আলোচনা করতে অভ্যস্ত অস্ত্রের ভাষায়। অর্থাৎ সংঘাত অপরিহার্য। তিনি বুঝেছিলেন, এই সংঘাত শুরু হলে একটিমাত্র গন্তব্যের দিকে তা যাবে—আমাদের স্বাধীনতার দিগন্তে। তাঁর বক্তৃতায় আমাদের করণীয় কী, তা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। বক্তৃতাটি সংক্ষিপ্ত—অর্থাৎ কথার দিন শেষ, এখন কাজের ক্ষেত্রে নেমে পড়তে হবে।
এ বক্তৃতায়ও বঙ্গবন্ধু মুক্তি কথাটি দ্বিবিধ অর্থে ব্যবহার করেছেন। স্বাধীনতা অর্থে—যখন তিনি বললেন, ‘যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো।’ ‘ইমানসিপেশন’ অর্থে, যখন ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ এবং তার পরপরই যোগ করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
রেসকোর্সের মাঠে উপস্থিত লাখ লাখ শ্রোতা আশা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণাটি দেবেন। কিন্তু তিনি জানতেন, এ ধরনের একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণা আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হয় না। তা ছাড়া সেই ভাষা আন্দোলন থেকে নিয়ে সেদিনের বক্তৃতা দেওয়া পর্যন্ত তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন। সেদিনও তিনি ওই আন্দোলনকেই সামনে নিয়ে এলেন, কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাটিও দিয়ে রাখলেন। ওই মাঠে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা পরদিন রেডিওতে বক্তৃতাটি শুনলেন, তাঁরা বুঝলেন, এরপর যা-ই ঘটুক, আমরা আমাদের নিজস্ব পথে পা রেখেছি, যার শেষ মাথায় আছে আমাদের স্বাধীনতা। সেটি আমরা একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করলাম।
যে মুক্তির কথা বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন, তা অর্জনের পথটা যে কঠিন, তা তিনি যেমন জানতেন, আমরাও তা জানতাম। এই মুক্তি অর্জনের জন্য প্রয়োজন সাম্য, সম্পদের সুষম বণ্টন; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অন্ন, বাসস্থানসহ সব অধিকারের সফল বাস্তবায়ন; সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ব্যক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য, জাতপাতের বিভাজন দূর করা। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল এই সার্বিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত।
আজ আরেক ৭ মার্চ। এই দিনে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংগ্রাম কোন পর্যায়ে আছে, সে প্রশ্ন আমাদের তুলতে হবে। কারণ, এখন বৈষম্য সর্বব্যাপ্ত, মৌলিক অধিকারগুলো থেকে মানুষ বঞ্চিত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বঞ্চনায় দেশের এক বিশালসংখ্যক মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। ন্যায়বিচার এখন দুষ্প্রাপ্য, মানুষ এক নতুন কৌলীন্যপ্রথায় শাসিত, কারণ শাসক-প্রশাসক-বিত্তশালীরা সব সুবিধা ভোগ করেন এবং সাধারণ মানুষকে সেই সুবিধাভোগের জন্য অবিরাম শ্রম দিয়ে যেতে হয়।
৭ মার্চ এলে আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি নিয়ে অনেক কথা বলি, এর ভাষাগত বিশ্লেষণ থেকে নিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি, কিন্তু তিনি যে মুক্তির সংগ্রাম শুরুর কথাও বলেছিলেন, সে কথা ভুলে যাই অথবা মুক্তিকে স্বাধীনতার প্রতিশব্দ বিবেচনা করে একটি অর্থেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতার শেষে ‘ইমানসিপেশন’-এর কথাই বলেছিলেন। সেই মুক্তির সংগ্রাম যদি সত্যিকার অর্থে পরিচালিত না হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর ভাষায় বলতে হয়, ‘দেশের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।’
● সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ