যুক্তরাজ্যের রাজনীতিকেরা যেভাবে মুসলিমবিদ্বেষ তাতিয়ে তুলছেন

যুক্তরাজ্যের রাজনীতিকেরা যেভাবে মুসলিমবিদ্বেষ তাতিয়ে তুলছেন
পিটার অবর্ন :

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার ও লেবার নেতা কেয়ার স্টারমার গাজা ইস্যুতে ইসলামভীতি ও ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছেড়েছেন। অবশ্য কয়েক মাস ধরেই যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে ইসলামবিদ্বেষী একটা ভাষ্য ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছিল।
ভাষ্যটা ছিল এমন, উগ্রবাদী ইসলামপন্থীরা লন্ডন দখল করে নিচ্ছে। তারা রাজনীতিকদের মনে ভয় ধরাতে পেশিশক্তি প্রদর্শন করছে, এবং পার্লামেন্টের কর্তৃত্বকে গুঁড়িয়ে দিতে বসেছে। সে কারণে এখন গণতন্ত্রই হুমকির মুখে।

গত ২৪ ঘণ্টায়, ব্রিটিশ মুসলিমরা ব্রিটেনের রাজনীতিকে কলুষিত করছে, এই অভিযোগ ভাইরাল হয়ে যায়।

সাবেক মন্ত্রী রবার্ট জেনরিক গত বৃহস্পতিবার কমনসদের উদ্দেশে বলেন, ‘ব্রিটেনের রাস্তাকে আমরা ইসলামপন্থী উগ্রবাদীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।’

রবার্ট জেনরিক বলেন, ‘যারা ইসলামপন্থীদের বক্তব্যের অমত করছে, তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে, সহিংসতার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। হাউস অব কমনসের অপর নেতা পেনি মরড্যান্ট বলেন, তিনি এই বক্তব্যের সঙ্গে শতভাগ একমত।

গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক আগুনে ঘি ঢেলেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘উগ্রবাদীরা হুমকি দিয়ে সংসদীয় কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে—এই সুযোগ আমাদের কখনোই দেওয়া উচিত হবে না।’

এই অভিযোগগুলো খুবই জোরালো। যদিও সুনাক কিংবা জেনরিক তাঁদের এই বক্তব্যের সমর্থনে কোনো সাক্ষী–প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।

ইসলামবিদ্বেষী ভাষ্যের এমন ভরভরন্তের প্রেক্ষাপটটা বোঝা প্রয়োজন। বুধবার স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি) গাজা যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব সমর্থন করে একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব টেবিলে উপস্থাপন করার পর ওয়েস্টমিনস্টারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

এই প্রস্তাব লেবার নেতা কেয়ার স্টারমারের জন্য খুবই বিব্রতকর ছিল, কারণ এই দলের সিংহভাগ সংসদ সদস্য গাজা যুদ্ধের সমর্থনে তাঁর অবস্থানের কঠোর সমালোচক।
কেন এসএনপি ও কনজারভেটিভরা স্পিকার স্যার লিন্ডসে হয়েলসের ওপর চড়াও হন, তা বুঝতে এই প্রেক্ষাপটটুকু বোঝা দরকার। কারণ, তিনি সংসদের কর্মী ও সংসদীয় রীতিনীতিকে উপেক্ষা করে লেবার পার্টিকে সংশোধনী প্রস্তাব উপস্থাপনের সুযোগ দেন। এতে স্টারমারের ওপর চাপ কিছুটা কমে।

হয়েলের পদত্যাগের জোরালো দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্পিকার বলে বসেন, তিনি বিতর্কিত এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, তিনি সংসদ সদস্য, তাঁদের পরিবার ও সংসদ সদস্যদের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।

পরদিন তিনি আবারও কমনসদের উদ্দেশে একই সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেন, ‘আমাকে যা কিছু জানানো হয়েছে তা অত্যন্ত ভয়জাগানিয়া, সংসদ সদস্যদের দেখভাল করা যদি আমার অন্যায় হয়ে থাকে, তাহলে আমি অপরাধী।’

স্টারমারই তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন এই বলে যে সংসদ সদস্যরা হুমকিতে আছেন।
তবে লেবার সংসদ সদস্যদের কারা হুমকি দিচ্ছে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য স্পিকার দিতে পারেননি। তবে ওয়েস্টমিনস্টারের কারোরই কোনো সন্দেহ নেই যে হুমকিদাতা বলতে আসলে মুসলিমদের বোঝানো হচ্ছিল।
দিনে যা ঘটেছে তার প্রতিফলন পরে ব্রিটিশ মিডিয়ায় দেখা যায়।

টক টিভিতে রাজনীতিবিষয়ক সাংবাদিক অ্যালিসিয়া ফিটযজিরাল্ড এই ভীতির বোধ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, লেবার সংসদ সদস্যরা, বিশেষ করে নারীরা কমনসের বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন, কারণ ওখানে ফিলিস্তিনপন্থী উচ্ছৃঙ্খল জনতা অবস্থান করছিল।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটা সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছি। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের আচরণ যদি এভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে বুঝতে হবে এখানে গণতন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করছে না।’

ডেইলি টেলিগ্রাফে গত শুক্রবার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান বলেন, ‘ইসলামপন্থী, উগ্রবাদী এবং ইহুদিবিদ্বেষীরা এখন সবকিছুর নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে।’ বৃহস্পতিবারের সানে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যরা ইসলামপন্থী গুন্ডাদের সহিংস হুমকির শিকার হচ্ছে।

এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস ও ইউকেআইপি নেতা নাইজেল ফারাজকে নিয়ে কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন সম্প্রতি একটি প্যানেল পরিচালনা করে। তাঁরা বলেন, উগ্র ইসলাম ব্রিটিশ রাজনীতিতে মূল ধারা হয়ে উঠেছে। ফারাজের ধারণা, ২০২৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ওয়েস্টমিনস্টারে ইসলামপন্থীদের জয়জয়কার দেখা যাবে। দেশটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

নিঃসন্দেহে যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুতর। যদি সত্যিই ‘উগ্র ইসলামপন্থী’রা (বা অন্য কোনো গোষ্ঠী) সংসদ সদস্য ও অন্যদের হুমকি দিয়ে থাকে, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
কিন্তু আমি এ নিয়ে একটা সতর্কতা জারি করতে চাই।
যারা হুমকির কথা বলছে, তারা কোনো সাক্ষ্য–প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। না স্পিকার, যিনি সংবাদমাধ্যমে ঝড় তুলেছেন; না স্টারমার, যিনি স্পিকারকে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন।

মনে রাখতে হবে, দৈহিক ও মৌখিকভাবে ভীতি প্রদর্শন অপরাধ বলে গণ্য হয়। মারধর কিংবা গালাগালি, এমনকি অনলাইনে গালাগালিও অপরাধ।

কেউ যদি কোনো সংসদ সদস্য বা রাজনীতিককে শারীরিকভাবে আঘাত করেন, তাহলে তাঁকে অবশ্যই বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
যদি এ ধরনের হুমকি দেওয়া হয়ে থাকে, যেমনটি স্টারমার বা স্পিকার হয়েল দাবি করছেন, তাহলে অবশ্যই শাস্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এবং তাদের কারাদণ্ড হবে। তবে এমন কিছু ঘটেছে তার কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।

অ্যালিসিয়া ফিটসজিরাল্ডের অতি উৎসাহী প্রতিবেদনের উল্টো বক্তব্য আসছে রাজনীতিবিষয়ক আরেক সাংবাদিক হুগো গাইয়ের কাছ থেকে। তিনি বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি সংসদ থেকে বের হন এবং বিক্ষোভকারীদের কাউকে দেখেননি।
অথবা স্কটিশ এমএসপি পল সুইনির কথা ভাবুন, যিনি বললেন গাজার প্রতিবাদকারীরা তাঁর গ্লাসগো অফিসে ঢুকে পড়েছিলেন! তাঁর দাবি ছিল, বিক্ষোভকারীরা তাঁর কর্মীদের ভয় দেখান ও অনবরত হুমকি দিতে থাকেন।

ন্যাশনালের মতে, ‘পুলিশ স্কটল্যান্ড এখন নিশ্চিত করছে যে তারা এমন কোনো ঘটনার সত্যতা খুঁজে পায়নি। লেবার কর্মীদের কেউ হুমকি দিয়েছে এমন খবরও তারা জানে না।’

ন্যাশনালের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘পুলিশ স্কটল্যান্ড আরও জানিয়েছে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ব্যাপারে তারা অবহিত ছিল এবং বিক্ষোভকারীরা স্বেচ্ছায় পরে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।’

সংসদ সদস্যরা সত্যিকার অর্থেই মনে করতে পারেন যে তাঁরা হুমকিতে আছেন, কিন্তু পুলিশসহ অন্যদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সহ্য করতে হয়। তাঁদের কার্যালয়ের বাইরে এমন বিক্ষোভ স্বাভাবিক। স্লোগানও স্বাভাবিক। কখনো কখনো নির্যাতনও। কারণ, এর সবই ঘটে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে।
এখন পর্যন্ত আমরা যা শুনছি, তার সবই কানকথা। সে কারণেই স্পিকার হয়েল ও স্টারমারের কথায় ফিরতে হলো।

আমরা চ্যানেল ফোরের রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদক গ্যারি গিবনের কাছ থেকে জানতে পারি যে স্টারমার লেবার সংসদ সদস্যদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই বলে যে তাঁরা তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় হুমকির মুখে পড়তে পারেন যদি না তাঁদের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।

আমরা আরও জানি, স্পিকার হয়েল এই মন্তব্যকে আমলে নিয়েছিলেন। তিনি কি স্টারমারের অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য–প্রমাণ চেয়েছিলেন? এখন পর্যন্ত এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।

ব্রিটিশ সংসদ সদস্যদের ওপর শারীরিক হুমকির শঙ্কা অমূলক নয়, এবং এই হামলা প্রাণঘাতীও হতে পারে। ব্র্যাডফোর্ড ওয়েস্টের সংসদ সদস্য জর্জ গ্যালাওয়ে ইসরায়েল সম্পর্কিত ধ্যানধারণার কারণে হামলার শিকার হয়েছিলেন লন্ডনের রাস্তায়। তিনি হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন।

আমি বলব, স্পিকারের এই বক্তব্যের পেছনে আরও কঠোর কোনো সত্য লুকিয়ে আছে। যদি তা-ই হয়, তবে স্টারমারের সহযোগিতা নিয়ে স্পিকারের উচিত হবে হয়েলের সহযোগিতায় এই সত্য প্রকাশ এবং অভিযোগের সত্যতা থাকলে বিচার করা।
যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া না যায়, তাহলে তাদের উচিত হবে বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা।

ওপেন ডেমোক্রেসির প্রতিবেদন অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির শুরুতে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অনুষ্ঠিত পদযাত্রা থেকে গ্লাস্টনবেরি মিউজিক ফেস্টিভ্যাল থেকে যত মানুষ আটক হয়েছেন, তার চেয়েও কম আটক হয়। প্রতি ১০ হাজারে এই সংখ্যা ছিল দশমিক ৫।

অক্টোবর ও ডিসেম্বরের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্য থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৫৩ জনকে। তাঁদের মধ্যে অভিযোগ গঠন ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ১১৭ জনকে।

মূলধারার ব্রিটিশ রাজনীতিকদের দাবি, ব্রিটিশ মুসলিমরা নিরাপত্তা হুমকি এবং তারা ব্রিটিশ গণতন্ত্র ধ্বংস করে দিতে চায়। এটা একটা ভয়ংকর ও উসকানিমূলক দাবি।

প্রথম আলো