মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সালাম

Daily Nayadiganta

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সালাম – নয়া দিগন্ত

বিজয়ের মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম জানাই। আমার এ সালাম একটি স্বাধীন দেশ অর্জনের জন্য যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি এবং যারা প্রবাসে থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করেছেন তাদের প্রতি। কারো অবদানই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। প্রবাসে যারা ছিলেন তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এমন জনমত গঠন করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্বাধীন গণমাধ্যমের দেশেও পাকিস্তান সরকারকে বিজ্ঞাপন দিয়ে পত্রিকায় খবর ছাপাতে হতো। তখন আমি যুক্তরাষ্ট্রে পিইএচডি করছি। ‘ডিফেন্স লিগ’ গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করছি। সে সময়ে আমি আক্ষেপ করে বলতাম, দেখ এই পাকিস্তানের জন্যই কি আমাদের দাদা-বাবা-চাচারা লড়াই করেছেন? তাদের স্বপ্ন ছিল মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি। আজ মুসলমানরাই মুসলমানকে হত্যা করছে। বাংলাদেশ অর্জনের মূল্য লক্ষ্য ছিল বৈষম্য ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি ও ন্যায্য অধিকার আদায়। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা অনেক আগে থেকেই বৈষম্যের শিকার ছিল। বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক জমিদার শ্রেণীর হাতে তারা শোষিত হচ্ছিল। ১৯২১ সালের আগে এই অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ। তাদের মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথও ছিলেন। এরপর পাকিস্তানের জন্য এই অঞ্চলের মানুষ রক্ত দিয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরপরই পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলো। এ দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, একটি শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে বা একটি দলের হাতে (ব্রিটিশদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণকারী হিসেবে তখন মুসলিম লীগ ছিল ক্ষমতায়) দেশ চালানোর ভার চলে গেলে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা মাথাচাড়া দিতে পারে। আসলে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের হাতে নবাব সিরাজউদদৌলার ষড়যন্ত্রমূলক পরাজয়ের পর থেকেই। ইংরেজরা এই বাংলার স্বাধীনতা মুসলমানদের হাত থেকে নিয়েছে। ফলে ঐতিহাসিকভাবে মুসলমানরাই প্রথম স্বাধীনতার লড়াই শুরু করেছিল। বঙ্গীয় বদ্বীপের মানুষ প্রকৃতিগতভাবে আবেগ প্রবণ। এখানকার ঋতু বৈচিত্র্য ও প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনেও পরিবর্তনের খেলা চলে। আমি পাপুয়া নিউগিনিতে ছিলাম। সেখানে দিন-রাত সমান। ঋতু বৈচিত্র্য নেই। দিনে রোদ, রাতে প্রবল বর্ষণ। দিনে কয়েকবার ভূমিকম্প। সব কিছু যেন ধরাবাধা। আমাদের এখানে সে রকম নয়। এই স্বাভাবের কারণে আমরা কিছুটা চরম মনোভাবাসম্পন্ন। যেদিকে ঝুঁকি, চরমভাবে ঝুঁকে পড়ি। যাকে প্রত্যাখ্যান করি, তাকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করি। আমরা যুক্তফ্রন্টের আমলে এই প্রবণতা দেখেছি। যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টি করল তাকে এই অঞ্চলের মানুষ এমনভাবে প্রত্যাখ্যান করল যে দলটি আর উঠে দাঁড়াতেই পারল না। যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলো সেই দলটিকে পরে এমনভাবে প্রত্যাখ্যান করা হলো, যে কিনা ২১ বছরের মধ্যে আর ক্ষমতাতেই আসতে পারল না। এখানে যখন প্রেসিডেন্টের শাসন ছিল তখন তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। আবার যখন প্রধানমন্ত্রীর সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো তখন তাকে এমন ক্ষমতাহীন করা হলো যে শুধু কবর জিয়ারত ও প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করা ছাড়া তার আর কোনো কাজ রইল না।

এরই প্রেক্ষাপটে আমি বলছি যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা দু’টি মৌলিক ভুল করেছি। প্রথমটি ছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পক্ষ ত্যাগ করে আসা সদস্যদের নতুন দেশের সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা। আমরা সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফোর্সের কথা জানি। স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সরদার বল্লবভাই প্যাটেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যারা সেনাবাহিনী ত্যাগ করে আজান হিন্দ ফৌজে যোগ দিয়েছিলেন তাদের তিনি আর ভারতের সেনাবাহিনীতে ফেরত নেননি। তিনি বলেছিলেন, তাদের আমি সালাম জানাই, তবে তাদের আমি বাহিনীতে ফিরিয়ে আনব না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর আমরা যে সশস্ত্র অরাজকতা দেখেছি, তার জন্য এই অন্তর্ভুক্তি দায়ী বলে মনে করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এরই শিকার। ১৯৭৩ থেকে ’৮০-এর দশকের প্রথম পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে কত ক্যু, পাল্টা ক্যু হয়েছে তার লেখাজোখা নেই। কত মানুষ মারা গেছেন, কতজন জেলে গেছেন, কত পরিবার ধ্বংস হয়েছে, রাষ্ট্রের কত সম্পদ বিনাশ হয়েছে, তার হিসাব নেই। তাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে না এনে যদি বলা হতো, আপনারা যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন; আপনাদের আমরা স্যালুট করি, আপরারা চিরকাল আমাদের হৃদয়ে থাকবেন কিন্তু আপনাদের আর সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিতে ফিরিয়ে আনা হবে না। আমি একেবারে নির্লিপ্ত দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি, যারা একবার রাষ্ট্রীয় শপথ ভঙ্গ করেছেন; তারা আবার ভঙ্গ করবেন না তার গ্যারান্টি ছিল কি? সেটি যে ছিল না তার সাক্ষী পরবর্তী ইতিহাস। তবে হ্যাঁ, তারা এদেশেরই ছেলেমেয়ে, তারা অত্যন্ত মেধাবী, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত, পরিশ্রমী ছিলেন। তাদের প্রশিক্ষণকে অন্যত্র কাজে লাগানো যেত। তাদের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেত। তখন তো সব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে তাদের আত্মীকরণ করা যেত। সেটি আমরা করিনি।

দ্বিতীয় ভুলটি হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর নামে নব্য জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সেই সুবাদে আমি সুবিধা পাবো, আমার উত্তরসূরি সুবিধা পাবে- এই প্রবণতা উন্নয়নের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। উন্নয়ন জটিল একটি বিষয়। উন্নয়ন দক্ষ শ্রমশক্তি, উদ্যোক্তাসহ আরো অনেক কিছুর সাথে জড়িত। একজন মুক্তিযোদ্ধা সব মিলিয়ে বছরে ভাতা পান এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। মাসে ১৪,২০০ টাকা। জীবনযাত্রার ব্যয় হিসাব করলে এই টাকা রাজধানীর একজন বাসিন্দার অন্তত ৪২,০০০ টাকা আয়ের সমান। অর্থনীতির পরিভাষায় ‘পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি’ নামে একটি কথা আছে। সেই হিসাবে গ্রামের এক টাকা শহরের তিন টাকার সমান ধরা যায়। গ্রামে যে সবজি ১০ টাকায় পাওয়া যায় সেটি শহরে কিনতে ৩০ টাকা লাগে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আছেন বেশির ভাগ গ্রামের মানুষ। বিনা পরিশ্রমে প্রতি মাসে কেউ ৪২,০০০ টাকার ক্রয়ক্ষমতা পেলে তিনি কেন কাজ করবেন? এ ব্যবস্থা দক্ষ শ্রমশক্তির উন্নয়ন ব্যাহত করবে। তিনি বড়জোর বিদেশে পারি জমাতে পারেন নিম্নশ্রেণীর কাজ করার জন্য। তা না হলে বসে বসে খাবেন। অর্থাৎ আমরা জমিদারি ব্যবস্থাকেই নতুন আদলে নিয়ে আসছি। একটি শ্রেণীর মধ্যে জমিদারির মনোভাব তৈরি করছি। এটা জাতীয় উন্নয়নের জন্য আত্মঘাতী হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুবিধাদি হতে পারে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটা চলতে পারে না। আমরা প্রকারান্তরে তাদের পঙ্গু করে দিচ্ছি। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের বদলে উল্টোটা হচ্ছে। আমি সরকারকে উপরিউক্ত বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে বলব। এ কথাগুলো বলছি আমার একাডেমিক জ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। অভিজ্ঞতা আমাকে বাস্তববাদী হতে শিখিয়েছে। এটা একান্তই নিজস্ব অভিমত। এর মানে এই নয় যে সবাই আমার কথা মানবেন। তবে বিতর্কের মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হতে পারব। আমি একটি হাইপোথিসিস দিলাম। এর ওপর গবেষণা করা যেতে পারে।

উন্নয়ন একটি জটিল ইস্যু। এটা বৈশ্বিক অগ্রগতির সাথে সাথে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এখন আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান দিচ্ছি। ২০ বছর আগেও এই স্লোগান ছিল না। টেলিগ্রাফের যুগ থেকে মোবাইলের যুগে আসতে বেশি দিন লাগেনি। কয়েক বছর আগেও অফিসগুলোতে টাইপরাইটারের আওয়াজে কান ঝালাপালা হতো। এখন কম্পিউটারও পুরনো হয়ে গেছে। অর্থাৎ দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে জাতির অগ্রগতি হবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর নামে আমরা উন্নয়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছি কি না তা পর্যালোচনা করে দেখার সময় এসেছে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]