বাতাসে নানা গুজব। গুজবে সোস্যাল মিডিয়া উত্তাল। অনলাইন ও সোস্যাল মিডিয়া গত ক’দিন ধরেই গুজবে ভাসছে। রোববার দিনভর চাউড় ছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কি ঘটতে যাচ্ছে তাঁর কোন বিশ্লেষণ কারো কাছে নেই। এমনো বলা হচ্ছিল রোববার রাতেই পড়ে যাচ্ছে সরকার। সোস্যাল মিডিয়ায় গুজব থাকলেও রাজনীতির মাঠ ছিল নীরব। এই নীরব মাঠে কিভাবে কি হবে, এনিয়েও ছিল নানা প্রশ্ন। তবে নীরবতা ভেঙ্গে করোনায় স্থবির রাজনীতি হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সোমবার (১৪ ডিসেম্বর)। শীতের এই মাসটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠার নজির রয়েছে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘটনাই ঘটে সোমবার দুপুরে। ঢাকার রাজপথে হঠাৎ করেই হাসিনা পতনের শ্লোগান ওঠে। জিপিও মোড়ের জিরো পয়েন্ট হয়ে মুক্তাঙ্গণ পর্যন্ত মুহূর্তে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শ্লোগানে। শেখ হাসিনার বিদায়ের ডাক দেয়া হয় এই শ্লোগান থেকে। এ সময় সরকার বিরোধী স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। শ্লোগানে শ্লোগানে জিপিও হয়ে পল্টন মোড় ঘিরে মুক্তাঙ্গনে অবস্থান নিতে শুরু করেন বিভিন্ন সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব দাবী করেছেন এই সমাবেশের সাথে দলটির কোন সম্পৃক্ততা নেই। সমাবেশে অংশ নেয়ায় দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদকে শো’কজ করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
সোমবার রাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী শোকজের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করে বলেন, দলের নাম ব্যবহার করে নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্ত করে সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তাদের নোটিশ দেয়া হয়েছে। কেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না সে বিষয়ে শওকত মাহমুদকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এবং হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে পাঁচ দিনের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লিখিত জবাব জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
রিজভীর স্বাক্ষরে হাফিজ উদ্দিনকে পাঠানো নোটিসে বলা হয়েছে, ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে দলকে বিভক্ত করে মহাসচিব হওয়া, বিভিন্ন সময়ে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দায়িত্ব দেওয়া হলে সেটা করতে অপরাগতা প্রকাশ করা, বিশেষ করে কৃষক দলের মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তা করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অসম্মান করে বক্তব্য প্রদান করেছেন।
অপর দিকে সোমবার নেতাকর্মীদের অবরোধে পল্টন থেকে গুলিস্তান, প্রেসক্লাব ও কাকরাইলের সব রাস্তা অচল হয়ে পড়ে। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি তারা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তোপের মুখে পড়ে চলে যেতে হয় তাদেরকে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক সংখ্যক সদস্য সেখানে দ্রুত গতিতে উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণের জন্য গোটা এলাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।
যেভাবে জিরোপয়েন্ট হয়ে মুক্তাঙ্গনে জমায়েত শুরু হয়:
সোমবার ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এদিবস উপলক্ষে সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে পেশাজীবী পরিষদের উদ্যোগে একটি আলোচনা সভার আয়োজন ছিল। ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এ আলোচনা সভায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
এতে বক্তব্য রাখেন, মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদসহ পেশাজবী নেতৃবৃন্দ।
পেশাজীবী পরিষদের আলোচনা সভা ঘিরে বিভিন্ন সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো হন প্রেসক্লাবে। আলোচনা সভা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সেখান থেকে নেতাকর্মীরা মুক্তাঙ্গনের দিকে অগ্রসর হন।
হাজার হাজার লোকের সমাবেশ ঘটলেও পুলিশ বলছেন ওই সমাবেশকে তিন-চারশ লোক ছিল। পল্টন থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, দুপুরে তিন থেকে চারশ বিএনপি কর্মী প্রেস ক্লাব থেকে এসে মুক্তাঙ্গনে জড়ো হয়। এসময় তারা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে স্লোগান শুরু করে। মিছিলটি পল্টন মোড়ে আসে এবং চারিদিকে যানজটের সৃষ্টি হয়। তখন পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
যা ঘটেছিল রোববার
আগের দিন রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘এ ব্যাটল ফিল্ড ফ্রিডম ফাইটার অফ ১৯৭১’ ব্যানারে একটি অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে ১৮ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন। তারা সকলেই দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত। তবে রোববার একই মঞ্চে বসে বক্তব্য দিয়েছেন তারা। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ। তিনি সভাপতির বক্তব্যে বলেছিলেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তিনি আরো বলেছিলেন, গৃহযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। দেশ আফগানিস্তান হলে বা গৃহযুদ্ধ হলে তার জন্য দায়ী হবে আওয়ামী লীগ সরকার। দুঃশাসনের অবসান হওয়া প্রয়োজন। দুঃশাসন থেকে মুক্তি চাইলে গণভ্যুত্থানের বিকল্প নাই।
সমাবেশে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সহ অন্য বক্তারাও সভাপতির বক্তব্যের আগে একই সুরে কথা বলেছিলেন।
এই সভায় বহুল আলোচিত ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেনও বক্তব্য রাখেন। এক নারী সাংবাদিকের সাথে তর্কে জড়িয়ে বিভিন্ন মামলায় কারাভোগের পর দুই বছর ধরেই এক রকম নিখোঁজ ছিলেন তিনি। অনেকদিন পর স্বরূপে হাজির হন প্রেসক্লাবের এই আলোচনা সভায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভয়ভীতি বিরাজ করছে। সরকার লুটপাটতন্ত্র চালু করেছে। মানুষের মুক্তি মানেই গণতন্ত্রের বিজয়। আমরা এখন যে বিজয় দিবস পালন করছি সেটা আমাদের বিজয় নয়।
বিমান বাহিনী সাবেক প্রধান এভিএম ফখরুল আজমও এতে বক্তব্য রাখেন। ঘোষণা দেন আন্দোলনে সবার সঙ্গে আছেন তিনি।
সোস্যাল মিডিয়ায় গুজবের পাশাপাশি তাদের এমন উপস্থিতি ও গরম বক্তব্যে রাজনীতি হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
এদিকে রবিবার রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলাবলি হয়, মাহমুদুর রহমান মান্নার বাসা পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে। মান্না সোমবার গণমাধ্যমকে জানান, রোববার তার গুলশানস্থ বাসার আশপাশে প্রচুর লোকজন ছিল। রাত ১২টার পর পুলিশ তার বাসায় আসে। তারা বাসার দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে বিভিন্ন তথ্য জানতে চায়। বাসায় প্রশাসনের লোক, সাংবাদিক বা আর কেউ এসেছিলেন কি না তা জানতে চায়। পুলিশ অবশ্য তার সঙ্গে দেখা করতে চায়নি। খোঁজখবর নিয়েই তারা চলে যায়।
রোববারের আলোচনা সভায় অনেকের উপস্থিতি ও গণঅভ্যূত্থানের পক্ষে বক্তব্য দেয়া এবং এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার পেশাজীবী পরিষদের সমাবেশ থেকে গুলিস্তানে গিয়ে রাস্তা অবরোধ করে সরকার পতনের শ্লোগানের মধ্যে মিল খুঁজে পায় অনেকে। পর্দার আড়ালের রাজনীতি মাঠে গড়াচ্ছে বলেও মন্তব্য করতে শোনা যায় অনেকের মুখে।
তবে বিএনপি মহাসচিব গুলিস্তানের সমাবেশের সাথে বিএনপি’র সম্পৃক্ততা উড়িয়ে দিয়েছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সোমবার গুলিস্তানে বিএনপির দলীয় কোন কর্মসূচি ছিল না। সরকার পতনের শ্লোগান দিয়ে গুলিস্তানে জড়ো হওয়া কর্মসূচির সাথে বিএনপি’র সম্পৃক্ততা নেই।
শওকত মাহমুদকে শো’কজ নোটিশ
গুলিস্তানের সমাবেশে অংশ নেয়ার কারণে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদকে শো’কজ নোটিশ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে সভা-সমাবেশে অংশ নেয়ার অভিযোগে এই নোটিশ দেয়া হয়েছে বলে জানান বিএনপি’র একজন নেতা
পেসক্লাব কেন্দ্রিক সভা-সমাবেশে যোগ দিতে নিষেধাজ্ঞা:
বিএনপি’র দায়িত্বশীল একটি সুত্র জানায়, প্রেসক্লাব কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠনের সভা-সমাবেশ হয়। বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের প্রেসক্লাব কেন্দ্রিক কোন সভা-সমাবেশে যোগদান থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে দলীয় হাইকমান্ড।
তবে বিএনপি যখন নিষ্ক্রিয় তখন প্রেসক্লাব কেন্দ্রিক সংগঠন গুলোই থাকে রাজনীতিকদের ভরসা। এসব সংগঠনের বিভিন্ন সভা সেমিনারে অংশ নিয়েই বিএনপি’র সিনিয়র নেতারা রাজনীতির কথা বলার সুযোগ পান।