মিয়ানমার ভেঙে কি কয়েক ভাগ হয়ে যাবে?

রোনান লি : মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে সতর্ক করেছেন যে ‘তাঁর দেশ কয়েক ভাগ হয়ে যেতে পারে’। সম্প্রতি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিশাল আকারের ভূখণ্ড হারানোর পর তাঁর দিক থেকে এ সতর্কবার্তা আসে। মিয়ানমারের জনগণকে সামরিক বাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান মিন্ট সোয়ে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, তাঁর এই আহ্বান মানুষ কানে তুলবে না।

সামরিক সরকার দেশের অনেক অংশের নিয়ন্ত্রণ হারালে ভীত হওয়া তো দূরে থাক মিয়ানমারের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের বেশির ভাগই সেনাবাহিনীর পরাজয় উদ্‌যাপন করছে। সামরিক জান্তা সরকার জনগণের মনোভাব পড়তে ভুল করেছে। অবশ্য এই ভুল তারা এবারই প্রথম করেনি। ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ এবং লাগাতার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দেখে সেনা অভ্যুত্থানের নেতারা বিস্মিত হয়েছিলেন।

বিরোধিতা দমনের জন্য সামরিক নেতারা নির্বিচার গ্রেপ্তার ও চূড়ান্ত মাত্রার সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছেন। রাজনৈতিক বন্দীদের সহায়তা দেয় এ রকম সংস্থার মতে, বর্তমানে ১৯ হাজার ৬৭৫ জন রাজনৈতিক বন্দী এখন কারাগারে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবাদকারী ব্যক্তিদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সেনারা স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছেন।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম দমাতে গিয়ে নিয়মিতভাবেই জনসাধারণের ওপর শাস্তির খড়্গ চাপিয়ে দিয়ে আসছে। মানুষের বসতি ও স্থাপনায় তারা ভয়াবহ বিমান হামলা করছে। এই শুদ্ধি অভিযানে হাজারো মানুষ নিহত হয়েছে। সাত লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

২০২১ সালে জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) গঠিত হয়। নির্বাসিত নেতাদের এই ছায়া সরকার রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ শুরু করে। তারা সামরিক জান্তা সরকার ও তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার জন্য সশস্ত্র যোদ্ধা গড়ে তোলে। এনইউজির সশস্ত্র যোদ্ধারা মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কয়েক ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বয় বাড়িয়ে চলেছেন। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী কয়েক দশক ধরে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে।

এ বিষয় মিয়ানমারের জান্তা সরকারের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, জান্তা সরকারের বৈধতা নির্ভর করে পুরো দেশের ওপর তারা কতটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে, তার ওপর। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর খসড়া করা  সংবিধানে কয়েক ডজনবার মিয়ানমারের ‘অখণ্ডতা’ শব্দটি এসেছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব হিসেবেই সংবিধানে ‘অখণ্ডতা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানকে বৈধতা দেওয়ার মূল চাবিকাঠি এটি। কেননা, পরবর্তী পাঁচ দশকের সামরিক শাসনের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে ওই অভ্যুত্থান।

স্বাধীনতাপ্রাপ্তির কয়েক বছরের মধ্যে (১৯৪৮-৬২) মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারকে দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সে সময় প্রধান প্রধান কয়েকটি শহর বাদে বাদবাকি এলাকার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুব বেশি ছিল না। এখন পরিস্থিতি আবার সে রকম। শহর ও সেনা ব্যারাকের বাইরে জান্তা সরকার আর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারছে না। এটি খুব খারাপভাবে জান্তার নৈতিক বল ভেঙে দিচ্ছে। জনগণের মাঝে প্রতিরোধের প্রেরণা তৈরি করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে জান্তা সরকার সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে শান স্টেটে। জাতিভিত্তিক তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সম্মিলিত আক্রমণে বিশাল একটা এলাকার নিয়ন্ত্রণ তারা হারিয়েছে। এই তিন গোষ্ঠী হলো, আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি ও টাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। এই তিন সশস্ত্র গোষ্ঠী মিলে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স (ভ্রাতৃত্ব জোট) গড়ে তুলেছে।

নভেম্বরে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের কাছে সামরিক বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। বেশ কয়েকটি সেনা  ব্যারাকের নিয়ন্ত্রণ তারা হারিয়েছে। ৯৯তম পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার নিহত হয়েছেন। এই ডিভিশন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছিল।

ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স মান্দালয় থেকে চীন পর্যন্ত প্রধান সড়কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই সড়ক মিয়ানমারের প্রধান অর্থনৈতিক করিডর।

মিয়ানমারের তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠী মিলে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গড়ে তুলেছে
মিয়ানমারের তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠী মিলে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গড়ে তুলেছেছবি : রয়টার্স

চীনের ভূমিকা

ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্যরা নিজেদের ভূখণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও তাঁরা নির্ভরশীল চীনের অস্ত্রের ওপর। সে কারণে চীনের হিন্টারল্যান্ড (পশ্চাৎভূমি) হিসেবে পরিচিত একটি অঞ্চলে হামলা করা বেইজিংয়ের সম্মতি ছাড়া সম্ভব হতে পারে না।

শান স্টেটে ব্রাদারহুডকে অভিযান চালাতে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের ওপর চীন ব্যাপকভাবে হতাশ। শান স্টেটের অনলাইন প্রতারণা কেন্দ্রগুলোয় কয়েক হাজার চীনা নাগরিক রয়েছেন। তারা পাচারের শিকার হয়েছেন। তাদের দাসদের মতো কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এ কেন্দ্রগুলো বন্ধে জান্তা সরকারের নিষ্ক্রিয়তা চীন সরকারকে হতাশ করেছে।

চীনের কৌশলগত অবস্থানে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ২০২১ সালের অভ্যুত্থান নিয়ে চীনকে ততটা উৎসাহিত হতে দেখা যায়নি। মিয়ানমারে নিযুক্ত চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ছেন হাই সাংবাদিকদের বলছিলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা সত্যিকার অর্থে চীন দেখতে চায়নি।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের নেতারা ঐতিহ্যগতভাবেই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রধান মিত্র। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া অং সান সুচির সঙ্গেও তাঁরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অনেক সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গেও তাঁরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখে চলেন।