মিয়ানমারে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয়

এম সাখাওয়াত হোসেন

কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ চলছে অনেক দিন ধরে। মিয়ানমারের এ সংঘাতের প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। ইতোমধ্যে সেখান থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনী বিজিপি, সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের ৩৩০ জন বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়ে কয়েক দিন পর ফেরতও গেছে। তা ছাড়া সীমান্তের ১৯ পয়েন্টে প্রায় ৯০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায়। আগে থেকে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই যেখানে শুরু হয়নি, সেখানে নতুন করে রোহিঙ্গাদের কি বাংলাদেশ আশ্রয় দেবে?

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত মিয়ানমারের সঙ্গে। প্রতিবেশী এ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। এর বড় একটা অংশই পড়েছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। এর মধ্যে নাফ নদও আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিবেশীর সঙ্গে স্বাধীনতার পর থেকেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমাদের তেমন সম্পর্ক ছিল না। অর্থাৎ আমাদের কোনো ‘লুকইস্ট পলিসি’ নেই। অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে যেভাবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা বা লেনদেন হয়েছে, মিয়ানমারের সঙ্গে তা হয়নি। এমনকি পাঠ্যপুস্তক কিংবা উচ্চশিক্ষায় তেমন গবেষণাও হয়নি; যেমনটা ভারত কিংবা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছে। এখনও তাদের ব্যাপারে জানাশোনা খুব সীমিত।

রোহিঙ্গা ইস্যুটি বলা চলে মিয়ানমারকে জানার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এখনও আমাদের যে জানাশোনা তা রোহিঙ্গা, আরাকান আর্মি বা রাখাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মিয়ানমারে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ওপর রাখাইনে যে নির্যাতন হচ্ছে, তাও আমরা ঠিকমতো জানতাম না। তবে নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গারা প্রথম বাংলাদেশে আসে। এর পরও কয়েকবার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু সে অর্থে বড় ঘটনা ঘটে ১৯৯২ সালে। ওই সময় রেজুপাড়া বিওপিতে মিয়ানমারের তখনকার নাসাকা নামে সীমান্ত বাহিনী আক্রমণ করে রাইফেল ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায়। তার পর থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ওই সময় বাংলাদেশের মারমুখী অবস্থানের কারণে বেশির ভাগ রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নিতে বাধ্য হয়।

একইভাবে রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সে সময় বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যায়। বিশ্বের অনেকেই তখন রোহিঙ্গাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের দেখতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও আসে। কিন্তু রোহিঙ্গারা যে গণহত্যার শিকার হয়ে এখানে আসতে বাধ্য হচ্ছে– সে বিষয়টি বাংলাদেশ তুলে ধরতে ব্যর্থ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের বিষয়ে সোচ্চার না হয়ে, যারা এদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, অর্থাৎ মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে বিষয়টা ঝুলে যায়।

ইতোমধ্যে সাত বছর পার হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আরও কত বছর লাগবে, বলা যায় না। মানে একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ। এই দীর্ঘ সময়ে একজন রোহিঙ্গাকেও পাঠানো যায়নি। দিন দিন বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এখানে মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে আক্রমণ চলছে, বিভিন্ন জায়গায় সামরিক বাহিনী যে ঘাঁটি হারাচ্ছে এবং রাখাইনে যেভাবে আরাকান আর্মি দখলের চেষ্টা করছে, তাতে পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে।

আমরা চেষ্টা করেছিলাম প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু ভারত কোনো রকম সাহায্য করেনি, বরং তারা মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে কাজ করছে। আমাদের আরেক বন্ধুরাষ্ট্র চীনের মাধ্যমেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করেছিলাম। চীনের ঐতিহাসিক প্রভাব আছে মিয়ানমারের ওপর। মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সীমান্ত চীনের সঙ্গে। চীন ৭০ বছর ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করছে, বিনিয়োগ করছে। এবং এই ৭০ বছরে মিয়ানমারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে হানাহানি চলছে। চীনও সে অর্থে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

তা ছাড়া রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি আগেও তৎপর ছিল। কিন্তু আমরা তা ধর্তব্যের মধ্যে নিইনি। এখনও রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস রাখাইনে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি জান্তা সরকারের সঙ্গে লড়াই করছে। মিয়ানমারজুড়ে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী এমন তীব্রভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশের সীমান্ত। জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাতের প্রভাব সীমান্তেও পড়ছে। রাখাইনের মংডুতে থাকত বেশির ভাগ রোহিঙ্গা। এখন মংডু দখলে নিতে আরাকান আর্মি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সে জন্যই বাংলাদেশের সীমান্ত এখন বিশ্বের সবচাইতে উত্তেজনাকর সীমান্তের একটিতে পরিণত। রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনী বিজিপি, সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আবার সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যেও উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। তারা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের স্বাভাবিকভাবেই আশ্রয় দিতে রাজি নয়। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে চাইলে বাংলাদেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিতে পারে।

বর্তমানে যেহেতু রাখাইন সীমান্তে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর কোনো কর্তৃত্ব নেই; সেখানে আছে আরাকান আর্মি; তাই আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্কের ওপর নির্ভর করবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ। এটা সত্য, সরকারিভাবে জান্তার সঙ্গেই আমাদের আলোচনা হবে। কিন্তু আরাকান আর্মির সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়ে আলোচনার বিষয়টিও ভাবতে হবে। এখানে বঙ্গোপসাগরের বিষয়টিও বলে রাখা দরকার। সেখানে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা দৃশ্যমান। আমেরিকা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি-আইপিএস নিয়ে এগোতে চায়; চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআই নিয়ে এগোতে চায় আর ভারতের রয়েছে কালাদান প্রজেক্ট। আরাকান আর্মির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো না থাকলেও ভারত চাইছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে। তবে আরাকান আর্মি বলছে, তারা চীন কিংবা ভারতের বিনিয়োগের ক্ষতি করতে চায় না।

এখন আমাদের করণীয় কী? আমাদের অগ্রাধিকার হলো রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পায় সে জন্য সেখানকার ছায়া সরকার-এনইউজি এবং আরাকান আর্মির সায় আছে। সে জন্য আমাদের সরকারি পর্যায়ে তথা সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন গ্রুপের মাধ্যমে বেসরকারিভাবে এনইউজি বা আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের বার্মার অ্যাক্টে বাংলাদেশের ভূমিকা সম্পর্কেও বলা আছে। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রও চাইবে বার্মা অ্যাক্টের মাধ্যমে মিয়ানমারে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে। সে লক্ষ্যে এনইউজিকে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করছে। সুতরাং সে বিষয়টি চিন্তা করেই বাংলাদেশকে এগোতে হবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি, এনএসইউ 

samakal