‘মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকবে, শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষ ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে তারাই জয়ী হবে,’ এই কথা এখন বোধ হয় ভুল প্রমাণিত হতে চলেছে। অথচ ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর বিদেশি সরকার ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর শক্তিমত্তা সম্পর্কে এমনটাই ভেবেছিলেন।
অপারেশন ওয়ান জিরো টু সেভেন শুরু হয় গত মাসের ২৭ তারিখ।
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত সশস্ত্র এই গোষ্ঠী দ্রুত মিয়ানমারের উত্তর দিককার রাজ্য শানের সামরিক ঘাঁটি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যপথের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নেয়। বর্ষা মৌসুমের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, এই গোষ্ঠীর আগ্নেয়াস্ত্রের মজুত এবং সামরিক সক্ষমতা অনেকটাই বেড়েছে। তারা দৃঢ়চিত্ত এবং তাদের সঙ্গে জনসমর্থন আছে। কারণ, সরকারের পক্ষে সে অর্থে কোনো জনসমর্থন নেই।
প্রতিরোধের শুরুর দিকে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), কোকাং চায়নিজ গ্রুপ, তা আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), পালং গ্রুপ এবং রাখাইনের দ্য আরাকান আর্মি (এএ) মিয়ানমারের সঙ্গে চীনকে যুক্ত করেছে, এমন মহাসড়কগুলো নিয়ন্ত্রণ করছিল।
চীন মিয়ানমারকে বলেছিল, এই দলগুলোকে সমর্থন দিতে। তারা মনে করেছিল এতে করে সীমান্ত এলাকার জীবন ও সম্পদ থাকবে এবং চীনা কর্মকর্তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা যাবে।
মিয়ানমার সরকারও বলেছিল তারা সীমান্ত এলাকায় স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। কিন্তু আদতে তারা এই অঞ্চল থেকে ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
অপারেশন ওয়ান জিরো টু সেভেন মিয়ানমার এবং বিদ্রোহীদের ঘরে ঘরে উচ্চারিত একটি নাম। বিদ্রোহী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এবং ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এই অভিযানে অংশ নিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই অভিযানে ২০ হাজার যোদ্ধা অংশ নিচ্ছেন এবং এই অপারেশনটি হবে দীর্ঘ। বিদ্রোহীদের এই অভিযানে মিয়ানমার জান্তাদের দুর্বলতা প্রকটভাবে ধরা পড়ে। যেভাবে তারা পরাজিত হয়েছে, তাতে মনে হয় তারা আসলে যুদ্ধ করতেই চায়নি।
উত্তরের যখন এই অবস্থা, তখন দক্ষিণে কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ) এবং তাদের মিত্র পিডিএফ গ্রুপ মিয়ানমারের সঙ্গে থাইল্যান্ড সীমান্তে হামলা চালায়। এশিয়া হাইওয়ের অন্তর্ভুক্ত এই অঞ্চলের শুরু ইয়াঙ্গুন, আর এর শেষ সীমা থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে মিয়াবতী। এর অর্থ হলো, দক্ষিণেও সামরিক জান্তাদের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে চলেছে।
পিইন ও লিন এবং মোগকে শহরেও মান্দালয় পিডিএফ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে পিইন ও লিন শহরে সেনাবাহিনীর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ছিল। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর একের পর এক সফল হামলা এটাই প্রমাণ করে যে সেনা সরকারের দিন ফুরিয়ে আসছে।
তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, নেপিডোতে সামরিক জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং নেশনওয়াইড সিজফায়ার অ্যাগ্রিমেন্টের (যুদ্ধবিরতি চুক্তি) অষ্টম বর্ষপূর্তি উদ্যাপনের দুই সপ্তাহের মাথায় এই আক্রমণের ঘটনাগুলো ঘটল। এনসিএ অনুষ্ঠানের পর তথাকথিত ‘শান্তি বিশেষজ্ঞরা’ নেপিডোতে জড়ো হন এবং সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সামরিক সরকারের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা ছাড়া এ ধরনের বৈঠকের আর কোনো কারণ থাকতে পারে না।
এই সময় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর আরও শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং সুসমন্বিত হওয়া প্রয়োজন। মিয়ানমারের নেতাদের উচিত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে কী কী করা উচিত, তা নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা করা। এই সরকার চাপে পড়েছে। মিন অং হ্লাইং সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে মুখ দেখাতে পারছেন না।
একসময়ে যেই জনতা রাস্তায় আন্দোলন করছিলেন, তাঁরাই এখন জান্তাদের হিংস্র হামলার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ, দেশের অবস্থা বহুদিন ধরে অস্থিতিশীল। এই পরিস্থিতিতে কি মিন অং হ্লাইং দেশে তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন? অসম্ভব। তিনি পারবেন না।
স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল নেতারা কি তাঁকে সরিয়ে দেবেন? কারণ, তিনি শুধু অসৎ নন, তিনি নিঃসন্দেহে একজন অযোগ্য জেনারেল।
খুব সম্প্রতি তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগীর দুর্নীতির দায়ে সাজা হয়েছে। তাঁকে দীর্ঘ কারাবাস দিয়েছেন দেশটির আদালত। মিয়ানমারের অপর দুর্নীতিবাজ লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোয়ে মিন্ট টানও দুর্নীতির দায়ে জেলে। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে তাঁর অধীন একজন কর্মকর্তা এবং বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে জেরা করা হয়। তাঁরাই জানান, কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তিনি আসলে কত শতাংশ হারে ঘুষ নিতেন।
মিয়ানমার নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের অনেকেই মনে করেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে ভাঙন শুরু হবে। প্রাণের মায়ায় সাবেক বেশ কয়েকজন সামরিক নেতা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা প্রতিবেশী দেশগুলোয় ইতিমধ্যে জায়গাজমি কিনে রেখেছেন।
(থাইল্যান্ডে নির্বাসিত মিয়ানমারের সাংবাদিকদের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী–তে মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে এই সম্পাদকীয়টা প্রকাশিত হয়।)
প্রথম আলো