অলিউল্লাহ নোমান
ফ্যাসিবাদের দালালদের প্রতি ওনার দরদ যেন উতলে পড়ছে! ইনিয়ে বিনিয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লবোত্তর সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদের নরিঙ্কুশ দালালদের পক্ষে সাফাই গাইছেন। এই মাহফুজ আনামরাই ভারতের দালালি করতে গিয়ে দেশের সর্বনাশ সব সময় ডেকে এনেছিলেন। এবারো ভিন্ন কায়দায় তিনি ফ্যাসিবাদের দালালদের রক্ষায় প্রকাশ্যেই কলম চালিয়েছেন।
বলছিলাম গত ২৩ আগষ্ট (২০২৪) ডেইলি স্টার বাংলা ও ইংরেজী উভয় পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত একটি বিশেষ সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে। শিরোণাম-‘প্রধান উপদেষ্টার হাতকে শক্তিশালি করুন’। শিরোণাম দেখলে মনে হবে বিপ্লবোত্তর সরকারের দরদী হয়ে তিনি এই সম্পাদকীয় লিখেছেন। আসলে কিন্তু তা নয়। পুরো সম্পাদকীয় জুড়ে শেখ হাসিনা ও ফ্যাসিবাদের অন্যতম সহযোগি ভারতের নিরঙ্কুশ দালাল শাহরিয়ার কবীর, হাসানুল হক ইনু এবং খুনি বিচারক ইনায়েতুর রহিমের বিরুদ্ধে মামলার কঠোর সমালোচনা করেছেন। এছাড়া রাশেদ খান মেনন, ৭১ টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাকিল আহমদ ও তাঁর স্ত্রী ফরজানা রূপাকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ দেখিয়েছেন তিনি। এই কথিত সাংবাদিক দম্পতির গ্রেফতার এবং মামলায় নাকি গণমাধ্যম ও মুক্ত সাংবাদিকতার ব্যতয় ঘটেছে। এদেরে প্রতি তাঁর দরদ দেখিয়ে নানা যুক্তি খাড়া করার অপচেষ্টা করা হয়েছে ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয়তে। তিনি জানতে চেয়েছেন শাকিল ও রূপা কোন আইন ভঙ্গ করেছিলেন।
মি. মাহফুজ আনামের প্রতি আমার অনুরোধ, দয়া করে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৪নং ধারাটি তেলাওয়াত করুন। ফরজানা রূপা এবং শাকিল আহমদ ও শেখ হাসিনার ইচ্ছা এবং অভিপ্রায় ছিল অভিন্ন। ফারজানা রূপা একাধিক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নে শেখ হাসিনাকে গুম এবং খুনে উস্কানি দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদের গুম-খুনের পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। ৭১ টিভির সংবাদ পরিবেশনে শেখ হাসিনার গুম ও খুনের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে প্রতিনিয়ত। ৩৪ নং ধারা স্পষ্ট করেই বলা আছে, ঘটনাস্থলে উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। যারা ঘটনা সংঘটিত করেন তাদের সাথে যোগসাজস এবং অভিন্ন ইচ্ছা থাকলে একই অপরাধে দণ্ডিত হবেন। সংবাদ সম্মেলনে ফারজানা রূপার উস্কানিমূলক প্রশ্ন এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফ্যাসিবাদের গুম-খুনের পক্ষে বিভিন্ন প্রতিবেদনই বলে দেয়, কি অপরাধ করেছেন শাকিল-রূপা। এছাড়া শেখ হাসিনাকে প্রতিটি মামলায় অভিযুক্ত করায়ও তিনি ক্ষোভ ঝেড়েছেন। পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুণ্ডারা যত খুন করেছেন সবই তারা শেখ হাসিনার নির্দেশে পালন করেছেন মাত্র। আয়না ঘর নামক গোপন বন্দিশালা কি শেখ হাসিনার ইচ্ছার বাইরে তৈরি হয়েছিল? এনিয়ে কিন্তু তিনি একটি শব্দও উল্লেখ করেননি।
১৫ জুলাই থেকে গণহত্যা শুরুর পর অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে আরো কঠোর হওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ বৈঠকে হাসানুল হক ইনু এবং রাশেদ খান মেনন সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কঠোর হওয়ার মানে তাহলে কি? গণহত্যাকে তীব্রতর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার তাগিদ নয় কি? ১৪ দলের বৈঠকে উপস্থিত থেকে যারা গণহত্যাকে তীব্রতর করার তাগিদ দিয়েছিলেন, তারা সকলেই সংঘটিত গণহত্যার জন্য দণ্ডবিধির ৩৪ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধী। শেখ হাসিনার সাথে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে তারা আসামী না হলে বরং শহীদদের প্রতি অবিচার হবে। এই খুনিদের প্রতি দরদ দেখিয়ে মাহফুজ আনাম নিজের অবস্থান স্বঘোষিতভাবে তাদের কাতারে নিয়ে গেছেন।
ইনায়েতুর রহিম একজন খুনি বিচারক। শেখ হাসিনার পছন্দেই বিচারকের আসনকে কলঙ্কিত করেছেন সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। এই অসনের অপব্যবহার করে বিচারের নামে নির্দোষ ব্যক্তিদের ফাঁসিতে হত্যার হুকুম দিয়েছেন। প্রচণ্ড বিদ্বেষ থেকে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলায় ফরমায়েশি রায়ে দেওয়া দণ্ড দ্বিগুণ করেছিলেন। এসবই ছিল আইনের ও বিচারকের আসনের চরম অপব্যবহার। অথচ, এই খুনি বিচারকের জন্য মাহফুজ আনামের দরদ যেন উতলে উঠেছে এখন! এরমাধ্যমে ইনায়েতুর রহিমদের অবিচার ও বিচারিক হত্যার পক্ষেই নিজের অবস্থানের জানান দিয়েছেন তিনি।
দলদাস ও ফ্যাসিবাদের উস্কানিদাতা সহযোগি কথিত গণমাধ্যমের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে এই সম্পাদকীয়তে। উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন প্রচারযন্ত্রের কার্যালয়ে হামলাকে মুক্ত গণমাধ্যমের উপর আঘাত বলার অপচেষ্টা করেছেন। তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর দৈনিক সংগ্রাম অফিসে দিনে দুপুরে হামলা চালিয়েছিল ভারতীয় এজেন্ট মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের ভুইফোঁড় একটি সংগঠন। পত্রিকাটির কার্যালয় ভাংচুর করেছিল এই ভূইফোড় মঞ্চের গুণ্ডারা। প্রবীন সম্পাদক আবুল আসাদকে টেনে হেচড়ে তাঁর অফিস থেকে নিচে নামিয়ে আনা হয়েছিল। সেদিন সংগ্রাম অফিসে হামলা এবং একজন প্রবীন সম্পাদককে গুণ্ডারা যেভাবে টেনে হেচড়ে নিচে নামিয়েছিলেন তাতে কিন্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কোন আঘাত আসেনি! মাহফুজ আনামদের কলমে সেদিন কোন সম্পাদকীয় বের হয়নি। অথচ, ফ্যাসিবাদের নিরঙ্কুশ দালাল হিসাবে খ্যাতি পাওয় শাকিল ও রুপাকে গ্রেফতারে তাঁর স্বাধীনতায় চুলকানি উঠেছে!
আরেকটু পেছনের দিকে গেলে আমার দেশ সম্পাদক প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমানকে দুই দফায় তাঁর কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারের বহু বছর আগে গাড়ি ভাংচুরের একাধিক কাল্পনিক মামলায় তাঁকে আসামী হিসাবে শ্যোন এরেষ্টই শুধু নয়, এসব মামলায় রিমাণ্ডেও নেওয়া হয়েছিল। মোট ৪৩দিন রিমাণ্ডে রাখা হয়েছিল। কুষ্টিয়ার আদালতে হাজিরা দিতে গেলে ২০১৭ সালে ছাত্রলীগের গুণ্ডারা আদালত পাড়ায় প্রকাশ্যে হামলা চালায়। হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই হামলায় রক্তাক্ত হয়েছিলেন আমার দেশ সম্পাদক। মাহমুদুর রহমানের উপর পরিচালিত নিপীড়ন, পুরাতন কাল্পনিক মামলায় শ্যোন এরেষ্ট দেখানো, রিমান্ডে নেওয়া, পুলিশের উস্থিতি ও সহযোগিতায় হত্যার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হামলায় মাহফুজ আনামদের মুক্ত গণমাধ্যম চর্চার স্বাধীনতায় আঘাত লাগেনি! তখন সংবাদ পত্র ও গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের স্বাধীন মত প্রকাশ ক্ষুন্ন হয়েছিল বলে কোন রকমের চুলকানি দেখা যায় নি তাঁর! বরং মাহফুজ আনামদের স্বগোত্রীয় গোলাম সারোয়ার, মঞ্জুরুল ইসলাম বুলবুলরা কলাম লিখে মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার ও কাল্পনিক মামলায় শ্যোন এরেষ্ট দেখানোকে জায়েজ করার জন্য অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে! অথচ, গণহত্যায় প্রকাশ্যে উস্কানি দেওয়া শাকিল ও রূপাকে গ্রেফতার এবং স্বঘোষিত ভারতীয় দালাল শাহারিয়ার কবিরের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তাঁদের কথিত মুক্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় চুলকানি উঠেছে!
লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক
Amardesh