মালয়েশিয়ায় বিলাসী জীবন শত শত বাংলাদেশির

মালয়েশিয়ায় বিলাসী জীবন শত শত বাংলাদেশিরছবি-সমকাল

‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে মালয়েশিয়া বাংলাদেশের ধনশালীদের বেশ পছন্দ। দেশটিতে আবাসন গড়তে তারা মিলিয়ন মিলিয়ন রিঙ্গিত (স্থানীয় মুদ্রা) খরচ করছেন। বাংলাদেশ থেকে নেওয়া এসব অর্থের উৎস নিয়ে মালয়েশিয়া সরকারের নেই কোনো জবাবদিহি। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন বাংলাদেশের ধনকুবেররা। এ কারণে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ আশপাশের অঞ্চলগুলোতে বড় বড় কনডোমিনিয়ামে (ফ্ল্যাট বা উঁচু ভবনসহ অ্যাপার্টমেন্ট) মালিক হিসেবে দেখা মিলছে অনেক বাংলাদেশির। সেই সঙ্গে অত্যাধুনিক সুবিধার বাংলোগুলোও তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরাবরের মতো এ বছরও পঞ্চাশোর্ধ্ব যে কোনো দেশের নাগরিক মালয়েশিয়ায় আবাসন গড়তে পারছেন। এ জন্য তাঁকে ব্যাংকে স্থানীয় মুদ্রায় ছয় লাখ রিঙ্গিত ফিক্সড ডিপোজিট জমা রাখতে হবে। বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় দেড় কোটি টাকা। সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাসিক আয় ১০ হাজার রিঙ্গিতের (আড়াই লাখ টাকা) ওপর দেখাতে হচ্ছে। আর আবেদনকারীর বয়স ৫০ বছরের নিচে হলে এ অর্থের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। সে হিসাবে ফিক্সড ডিপোজিট তিন কোটি টাকা ও মাসিক আয় দেখাতে হচ্ছে পাঁচ লাখ টাকা। অর্থাৎ মালয়েশিয়ার মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে এককালীন ১২ লাখ ও মাসিক ২০ হাজার রিঙ্গিত। এত কিছুর পরও থেমে নেই মালয়েশিয়ায় আবাসন গড়ার প্রতিযোগিতা।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে এখন বৈধভাবে অর্থ লগ্নি করে মালয়েশিয়ায় বাড়ি কেউ কিনছেন না। তারা গোপনে দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করে মালয়েশিয়া পাঠাচ্ছেন। দেশ থেকে এখানে হুন্ডি করে টাকা পাঠানো একেবারেই সহজ। নির্দিষ্ট হিসাবে টাকা জমা দিয়ে এখানে সেটা স্থানীয় মুদ্রা (রিঙ্গিত) হিসেবে নেওয়া যায়। এভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হুন্ডি হয়ে মালয়েশিয়ায় ঢুকছে। পরে সেই টাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিংবা বাংলো কিনে আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন তারা। শুধু তাই নয়, মালয়েশিয়ায় এখন বাংলাদেশি অধ্যুষিত বেশ কয়েকটি এলাকাও গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বাংলা মার্কেট ও শাহ আলী এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বাস করেন। এ ছাড়া কুয়ালালামপুরে বড় বড় কনডোমিনিয়ামে বাংলাদেশিরা বাংলো কিনে আধুনিক ইন্টেরিয়র ডিজাইনে সাজিয়েছেন। পাশেই সাইবারজায়া ও ফেডারেল সরকারের রাজধানী পুত্রজায়াতে দেখা মেলে এ ধরনের একাধিক বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কনডোমিনিয়ামের। সেখানে কাজ করেন বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের শ্রমিকরা।

যেভাবে আসছে টাকা 

মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, দেশটিতে বৈধ উপায়ে টাকা নেওয়ার কোনো উপায় নেই। পাচারের বড় মাধ্যম হুন্ডি ও ডিজিটাল ব্যাংকিং। মালয়েশিয়ার এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে একজন একবার বা দু’বার টাকা পাঠাতে পারে। তবে দেখা যাচ্ছে, এখন অবৈধ উপায়ে একজন মানুষ দিনে ইচ্ছামতো একাধিকবার টাকা পাঠাচ্ছেন।

কুয়ালালামপুরের কোতারায়া ও বুকিত বিনতাংয়ের বাংলাদেশি মার্কেটে একটু বেশি ভিড় থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মার্কেটে কেনাকাটা ও মানিচেঞ্জার সেন্টারগুলোতে টাকা পাঠাতে আসেন বাংলাদেশিরা। সেখানকার ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশি এজেন্টরা আবার টাকা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় ঢোকায় রিঙ্গিত হিসেবে। তাদের গ্রাহক বেশির ভাগই ব্যবসা কিংবা বাড়ি কেনার জন্য বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে থাকে।

বৃহস্পতিবার একটি মানি ট্রান্সফার সেন্টারের সামনে নোয়াখালী প্রবাসী আবুল হাসনাত আসেন দেশে টাকা পাঠাতে। মোবাইল ফোনে অন্যপ্রান্তে কথা বলে হুন্ডির মাধ্যমে ২৬ টাকা ১০ পয়সা রেটে টাকা পাঠালেন। যদিও অনলাইনে সরকারি রেট ছিল ১ রিঙ্গিতে ২৩ টাকা ২০ পয়সা।

যারা এই লেনদেনে জড়িত, তাদের ভাষ্য– হুন্ডিতে পাঠালে নগদ লাভ পেয়ে থাকি, আর ব্যাংকে পাঠাতে বিভিন্ন ডকুমেন্টস ও সময় লাগে। এ জন্য বাংলাদেশ হোক কিংবা মালয়েশিয়া– প্রথমে অবৈধ পথকেই বেছে নেয় সবাই।

কুয়ালালামপুরের ব্যাংক, মানি ট্রান্সফার, মানি এক্সচেঞ্জ, রেমিট্যান্স হাউসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ঘরে বসে, আবার কিছু কিছু এলাকায় প্রকাশ্যে অফিস খুলে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালাচ্ছে। শহরের আনাচে-কানাচে হাতের নাগালেই রয়েছে হুন্ডি চক্র। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকারের যেমন কোনো অভিযান নেই, তেমনি তাদের নিয়ন্ত্রণে কোনো দৃশ্যমান সচেতনতামূলক উদ্যোগও চোখে পড়েনি।

কারা কিনছেন কনডোমিনিয়াম 

মালয়েশিয়ায় এক বছর হলো বাড়ি কিনেছেন খুলনার আইয়ুব আলী। তিনি এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পুত্রজায়ার একটি কনডোমিনিয়ামে তাঁর প্রায় ১ হাজার ৭০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে। ভবনটি ৩২ তলা। সেখানে নানা আকারের ফ্ল্যাট ও ডুপ্লেক্স রয়েছে। আইয়ুব জানান, তাদের কনডোমিনিয়ামে বিভিন্ন ফ্লোরে একাধিক বাংলাদেশির রেডি ফ্ল্যাট কেনা আছে। তবে তারা কেউই এখানে বাস করেন না। রেডি ফ্ল্যাট হিসেবে তারা এগুলো ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। সেখানে দেড় থেকে তিন হাজার রিঙ্গিত পর্যন্ত ভাড়া পাওয়া যায়।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদের কর্মকর্তা বরিশালের সবুজ প্রামাণিকও কিনেছেন ফ্ল্যাট। এ ছাড়া ব্যবসায়ী আবুল ফজল, সিলেটের ফার্নিচার ব্যবসায়ী সৈকত আহম্মেদেরও ফ্ল্যাট আছে পুত্রজায়াতেই।

বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশের লাখো মানুষ মালয়েশিয়াকে তাদের ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এখনও কয়েক হাজার আবেদন প্রক্রিয়াধীন। আবেদনকারীরা এখানকার ব্যাংকে নির্ধারিত পরিমাণ ফিক্সড ডিপোজিটের টাকাও জমা করেছেন। এখন শুধু কাঙ্ক্ষিত কনডোমিনিয়াম পাওয়ার অপেক্ষা। এখানকার জর্জটাউন, ইপোহ, কুচিং, মলাক্কা, পেতালিং, জায়া কুয়ালা, তেরেঙ্গানু, সেরেমবান শহরে আধুনিক নির্মাণশৈলীতে দিনরাত শ্রমিকরা কাজ করছেন বিভিন্ন ভবনে। তৈরি হচ্ছে মার্কেট, রাস্তাঘাট। মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি বাংলাদেশি নাগরিক ‘মাই সেকেন্ড হোম’ সুবিধা নিয়েছেন। তবে এ তালিকায় চীনের নাগরিকরা শীর্ষে রয়েছেন।

সূত্র : সমকাল