মার্কিন বিবৃতির ‘বিটুইন দ্য লাইনস’ ভাষ্য

বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পরদিন এক বিবৃতির মাধ্যমে নাতিদীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে ঢাকা বিষয়ে ওয়াশিংটনের সর্বশেষ বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়েছিল ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। সেখানে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ‘ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ শুরু করেছে।’ দুটো বিবৃতিই দেন মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার।

২২ সেপ্টেম্বরের বিবৃতির পর থেকে দেশীয় ফেসবুকার ও প্রবাসী ইউটিউবারদের পক্ষ থেকে নানা নাটকীয় ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী চলছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ে সামান্য অনুসন্ধিৎসা পুঁজি করে তখন লিখেছিলাম– ‘যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যা বলার, বলা হয়ে গেছে। নির্বাচনের আগের তিন মাস পরিস্থিতির ওপর নজর রাখবে ওয়াশিংটন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দফায় ঢাকা ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা কতটা পালিত হচ্ছে’ (নির্বাচন নিয়ে মার্কিন মিশনের বঙ্গানুবাদ; সমকাল, ২২ অক্টোবর ২০২৩)।

নির্বাচন-পরবর্তী বিবৃতিটিতে তিনটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ এবং গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলের হাজার হাজার কর্মী গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনী অনিয়মে তারা উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, নির্বাচনটি অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় ওয়াশিংটন ‘দুঃখিত’। পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলকে সহিংসতা পরিহারের আহ্বান জানায়। তৃতীয়ত, মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি এগিয়ে নিতে এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরতর করতে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ (মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইট, ৮ জানুয়ারি ২০২৪)।

তার মানে যুক্তরাষ্ট্র যেমন ক্ষমতাসীন দলকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, তেমনি বিরোধী দলকেও সহিংসতা পরিহার করতে বলেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বও বজায় রাখতে চেয়েছে।
১০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসের প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে নিয়মিত হাত তুলে পরিচিতি পাওয়া এক প্রবাসী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগ সমন্বয়ক জন কিরবি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই এখনও বিশ্বজুড়ে কার্যকর ও প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বে বিশ্বাস করি এবং বাংলাদেশি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আমাদের ইচ্ছার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমাদের এ প্রত্যাশার মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে’ (সমকাল, ১১ জানুয়ারি ২০২৪)।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনটি নিয়ে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী? সর্বশেষ বিবৃতিটির ‘বিটুইন দ্য লাইনস’ বা ভাষার মারপ্যাঁচে আড়ালে থাকা বার্তা পড়ে যতদূর বুঝেছি, ওয়াশিংটন এখনই কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে চায় না। ঢাকাকে আরও সময় দিতে চায়, নির্বাচন-পরবর্তী পদক্ষেপগুলো দেখতে চায়। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতা, গ্রেপ্তার, হুমকির অভিযোগ নিয়ে নতুন মেয়াদের সরকার কী করে, সেটা দেখতে চায়।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সমন্বয়ক জন কিরবির বক্তব্যও জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতের মতো– “অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি।” বাংলাদেশ নিয়ে সুনির্দিষ্ট অবস্থানের বদলে ‘বিশ্বজুড়েই’ কার্যকর ও প্রাণবন্ত গণতন্ত্র দেখার দার্শনিক অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন তিনি।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতি দিয়েছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের তৎকালীন ডেপুটি মুখপাত্র রবার্ট প্যালাডিনো বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের আগের হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার বিভিন্ন বিশ্বাসযোগ্য খবরে আমরা উদ্বিগ্ন। এ বিষয়গুলো বিরোধী দলের অনেক প্রার্থী ও তাদের পক্ষের লোকজনের অবাধ সভা-সমাবেশ ও প্রচারণা কঠিন করে তুলেছিল। নির্বাচনের দিন অনিয়মের কারণে কিছু নাগরিকের ভোট না দিতে পারার বিষয়টিও উদ্বেগের। এটি নির্বাচনের প্রতি আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমরা সব পক্ষকে সহিংসতা পরিহার করতে জোরালোভাবে উৎসাহিত করছি’ (পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইট, ১ জানুয়ারি ২০১৯)।

২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তৎকালীন ডেপুটি মুখপাত্র মেরি হার্ফ বলেছিলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ‘হতাশ’ এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা সম্পর্কিত সহিংসতাকে ‘কঠোরতম ভাষায় নিন্দা’ জানায় (পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইট, ৬ জানুয়ারি ২০১৪)।

বাংলাদেশের গত তিনটি সাধারণ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি তিনটি যদি তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে সবচেয়ে কড়া ২০১৪ সালে; তখন ক্ষমতায় ওবামা প্রশাসন। সবচেয়ে নরম ২০১৮ সালের বিবৃতি; ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি এর কারণ হতে পারে। এই মুহূর্তে যেটা প্রাসঙ্গিক, ২০২৪ সালের বিবৃতিটির মাত্রা আগের দুই বিবৃতির মাঝামাঝি। না মিঠে, না কড়া।

অবশ্য ওয়াশিংটন সবচেয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। প্রথমে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর এবং পরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহতকারী ‘সম্ভাব্য সবার’ ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে মনে হচ্ছে, বাংলা প্রবাদ মেনে যতটা গর্জন দেখিয়েছে ততটা বর্ষণ দেখাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র।

‘বিবিসি বাংলা’ মনে করছে, ‘এবার এটাও একটা বাস্তবতা যে, ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বের ভূরাজনীতি অনেকটা বদলে গেছে। বিশ্বে আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে চীন-রাশিয়া। বিদেশ নীতিতে ইউরোপের মধ্যেও অনৈক্য আছে। এর মধ্যেই ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ এবং আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন– এই দুইয়ে মিলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামনে অনেক ইস্যু। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর এসব কিছুর ব্যস্ততায় এবং পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশকে কতটা মার্কিন নীতির অগ্রাধিকারে রাখবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন’ (১৩ জানুয়ারি ২০২৪)।

কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি যদি বড়শি হয়, ভিনদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা হচ্ছেন ফাৎনা। তাঁর প্রতিক্রিয়া ও তৎপরতা দেখে সেই দেশের অবস্থান অনুমান করা যায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি চলাকালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যতটা তৎপর ছিলেন, ১৫ নভেম্বর তপশিল ঘোষণার পর তিনি যেন ততটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। পরদিন ১৬ নভেম্বর তিনি বরং ‘ছুটি কাটাতে’ ঢাকা থেকে কলম্বো যান। দিন দশেক পরে ঢাকায় ফিরলেও নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দিতে আর দেখা যায়নি তাঁকে।

১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে পিটার হাসও ছিলেন। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘এক্স’ (টুইটার) হ্যান্ডেলে একটি আলোকচিত্র পোস্ট করে লিখেছেন– ‘গত সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রিসভার কয়েকজন নতুন সদস্যের সঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে দেখার বিষয়টি ছিল খুবই চমৎকার।’ ছবিতে জনাকীর্ণ বঙ্গভবন চত্বরের ছোট্ট বৃত্তে প্রধানমন্ত্রী, নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যসহ পিটার হাসকে দেখা যায়। সবাই হাস্যোজ্জ্বল। যদিও ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইট, দাপ্তরিক সামাজিক মাধ্যমে এ ব্যাপারে কোনো পোস্ট দেখা যায়নি।

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই কবি জীবনানন্দ দাশের মতো; অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চায় না। আমার ধারণা, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ঢাকার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ ঘোষণার আগেও ওয়াশিংটন কয়েক মাস সময় নিতে চায়। সেই সময়ের সুবিধা ঢাকা কতখানি নিতে পারবে, পুরান সরকারের নতুন মেয়াদের চিন্তা ও তৎপরতার ওপর তা বহুলাংশে নির্ভর করছে।

সমকাল