মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই রাশিয়া থেকে সরকার-টু-সরকার (জিটুজি) ভিত্তিতে বাংলাদেশ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য আমদানি করবে। এই বিষয়ে এমওইউ চুডান্ত করেছে উভয় দেশের সরকার। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ১০ মার্চ রুশ ফেডারেশনরে জেএসসি ফরেন ইকোনমিক কর্পোরেশন ‘প্রডিন্টরগ’ এবং বাংলাদেশের ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশরে (টিসিবি) মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হবে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, উভয় দেশ চুক্তির বিষয়ে একমত হয়েছে। আশা করচ্ছে আগামী ১০ তারিখের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হবে। চুক্তি হওয়ার পর রুশ ফেডারেশনের দেওয়া পণ্য তালিকা থেকে বাংলাদের প্রয়োজনীয় পন্য নির্বাচন করা হবে। এরপর উভয় দেশের কর্মকর্তারা বসে একমত হওয়ার পর আমদানির পর্যায়ে যাবে।
জানা গেছে, সম্ভাব্য পণ্য তালিকার মধ্যে রয়েছে, হলুদ মটর, ছোলা, লাল মসুর, সবুজ মসুর ডাল, গম, সয়ারিন তেল এবং সূর্যমুখী তেলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য। খাদ্যপণ্যের বাইরে সার এবং জ্বালানি তেলকে গুরুত্ব দিচ্ছে রাশিয়া।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জেএসসি পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি দেওয়া হয়েছিল। এটি রাশিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। চিঠিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করে রাশিয়া। বিশেষ করে জিটুজি ভিত্তিতে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, তারা সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মূল্যে এসব খাদ্যপণ্য সরবরাহ করার সুযোগ নিতে চায়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রস্তাবটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশ থেকেই গম, সূর্যমুখী তেল ও সার আমদানি করত বাংলাদেশ। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে এসব আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রাষ্ট্রমালিকানাধীন টিসিবি দেশের এক কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করছে, যেখানে মসুর ডালও দেওয়া হয়। ফলে টিসিবিকে মসুর ডাল আমদানি করতে হয়। এছাড়া বাংলাদেশে সূর্যমুখী তেলেরও চাহিদা রয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দামে এসব পণ্য পাওয়া গেলে রাশিয়া থেকে আমদানি করা যেতে পারে বলে তারা জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যেসব পণ্য আমদানি করি, সেসব পণ্য কম দামে রাশিয়া থেকে আমদানির সুযোগ থাকলে তা নেওয়া যেতে পারে। তবে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সুইফট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর বাইরে রাশিয়ার অনেক জাহাজের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। এই বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি তথা লেনদেন কম খরচে, দ্রুত ও সহজ করতে সরাসরি মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তিতে জোর দিয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের সঙ্গে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকা সরাসরি বিনিময় করা যায় না। এক্ষেত্রে ইউরো বা ডলারের মাধ্যমে অর্থাৎ তৃতীয় মুদ্রার (বিনিময় প্রত্যাশী দুই মুদ্রার বাইরে অন্য কোনো মুদ্রা) মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন করতে হয়। এতে একদিকে খরচ যেমন বেশি হচ্ছে, সময়ও লাগছে বেশি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের মধ্যে লেনদেন কম খরচে, দ্রুত ও সহজ করতে সরাসরি বিনিময় হার চালু করতে চায় বাংলাদেশ।
২০২২ সালের শুরুর দিকে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন-এর (ইএইইউ) সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন এই অর্থনৈতিক ইউনিয়নের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে বেলারুশ, কাজাখস্তান, আর্মেনিয়া ও কিরগিজস্তান। এই এফটিএর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন খাতের রপ্তানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো।
পূর্ব ইউরোপের এই পাঁচটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বছরে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, এফটিএ চুক্তি করলে এই বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে।
২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ও ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন মস্কোতে সহযোগিতা স্মারক (এমওসি) স্বাক্ষরের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। পরে ১৯টি খাতে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে ইউরেশিয়ান বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। এ বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের (আরএমজি) রপ্তানি ছিল মোট ৪২৬ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। রপ্তানিকারকরা মনে করেন, চলমান যুদ্ধ না থাকলে রাশিয়া একাই বাংলাদেশ থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করতে পারত।
২০২২ সালের ১৪ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া একটি প্রতিবেদনে সরকারকে গম, সার ও ভোজ্য তেলের মতো প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য আমদানির বিনিময়ে রাশিয়ায় ওষুধ ও আলু রপ্তানির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার সুপারিশ করেছিল মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাস। এ বাণিজ্য জিটুজি ভিত্তিতে অথবা মুদ্রা বিনিময়ের (কারেন্সি সোয়াপ) মাধ্যমে সহজে করা যেতে পারে। এভাবে বাণিজ্য করলে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফটে রাশিয়ার অংশগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় পশ্চিমা চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়া মস্কো বাংলাদেশের সমর্থন চেয়ে একের পর এক চিঠি পাঠিয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রাশিয়া আগে কখনও মুখ না খুললেও বছরখানেক ধরে তাদের অবস্থান পাল্টেছে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনীতিবিদদের ভূমিকাকে নব্য উপনিবেশবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এ ধরনের পদক্ষেপ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ’।
বাংলা আউটলুক