বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল নিয়ে আসা জাহাজটির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকায় বাংলাদেশে ভিড়তে না দেয়ায় পণ্যগুলো এখন ভারতে খালাস করে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নৌ-পরিবহন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই রাশিয়া ও ভারতের সাথে আলোচনা শুরু করেছে।
তবে বাংলাদেশ যদি রাশিয়ার সাথে আলোচনার মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে মালামাল আনায় বিলম্ব এবং বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা। এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হতে পারে।
পাবনার রূপপুরে বারশ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ চালু করার কথা রয়েছে।
আর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এই প্রকল্পের মালামাল রাশিয়া থেকে আসছে। রাশিয়া এখানে অর্থায়নও করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে রাশিয়ার যেসব জাহাজ আছে সেগুলো দিয়ে এর আগেও মালামাল বহন করা হয়েছে।
এখন বাংলাদেশ যদি রাশিয়ার সাথে আলোচনার মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করতে পারে তাহলে খুব একটা সমস্যা হবে না।
রাশিয়ার সাথে সম্পর্কে চিড় ধরবে?
বাংলাদেশে জাহাজ ঢুকতে না দেবার বিষয়টি রাশিয়া ভালোভাবে নেয়নি। বিষয়টি তারা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে।
রাশিয়া মনে করতে পারে বাংলাদেশ রাশিয়াকে উপেক্ষা করে আমেরিকার দাবি গ্রহণ করেছে।
“একটা তো আশংকা থাকছে, সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না,” বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।
“রাশিয়াকে এই বার্তা দিতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে যে তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এ ধরণের একটা প্রশ্নবিদ্ধ বাহন আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে এবং সে জায়গায় আমরা রিস্ক নিতে আগ্রহী নই,” বলেন মি. কবির।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গত ১৪ বছর ধরে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন এবং ভারতের সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে।
অনেকে মনে করেন বাংলাদেশ সরকার যেভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে সেটি হয়তো দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।
ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে এখন কৌশল বদল করতে হবে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।
বৃহৎ দেশগুলোর সাথে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে, নন-অ্যালাইন্ড ব্যালেন্স। অর্থাৎ কোন পক্ষে না যাওয়া। কিন্তু এখন ভারসাম্য রক্ষার জন্য কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।
“কার চাহিদা কী সে বুঝে এবং আমার চাহিদা কী – এ দুটোর মধ্যে একটা সাযুজ্য তৈরি করতে হবে। যেটা এতোদিন আমাদের করতে হয়নি। আমি কার সাথে কোন কোন পর্যায়ে সম্পর্ক বজায় রাখবো সেটা আমাকে নির্ধারণ করতে হবে,” বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মি. কবির।
গত কয়েকমাসে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে আমেরিকা সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে চাচ্ছে।
এতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের অসন্তুষ্টিও প্রকাশ পেয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে ঢাকার রুশ দূতাবাস এক বিবৃতি দিয়েছে, যাতে পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাকমেইল এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার’ অভিযোগ তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিককে ইঙ্গিত করে রাশিয়ার মতো আরেকটি দেশের দূতাবাস থেকে এধরণের বিবৃতি এক নজিরবিহীন ঘটনা।
নাম ও রং পাল্টে রাশিয়ার জাহাজ আসছিলো
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকাস্থ রুশ এবং মার্কিন দূতাবাসের মধ্যে যখন পরস্পরবিরোধী বিবৃতির প্রেক্ষাপটে চলছে ঠিক সে সময় রাশিয়ার একটি জাহাজকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
উরসা মেজর নামের রাশিয়ার পতাকাবাহী এই কার্গো জাহাজটি বাংলাদেশের রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জিনিসপত্র নিয়ে মোংলা বন্দরে আসার কথা ছিল ২৪শে ডিসেম্বর।
বাংলাদেশের নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা জাহাজটি বাংলাদেশের পথে ছিল।
“যেহেতু আমেরিকান স্যাংশানের আওতায় সে জাহাজটি আছে, এটা আমাদের জানা ছিল না। এখন যেহেতু এটা স্যাংশনের আওতায় এসেছে সে ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।”
বাংলাদেশের রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করছে রাশিয়া। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত।
সে মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে কয়েকদিন আগেই এক বৈঠকে রাশিয়ার জাহাজটিকে বাংলাদেশে ঢুকতে না দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এই জাহাজটি বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেবার জন্য রাশিয়ার দিক থেকে বাংলাদেশকে চিঠি দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমেরিকার আপত্তিকে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। “এটা অলরেডি সেটেলড হয়েছে। সবকিছু বিচার বিবেচনা করে দেশের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন সে কর্মকর্তা।
আমেরিকার আপত্তি
চলতি বছরের মে মাসে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট রাশিয়ার মেরিটাইম সেক্টরকে টার্গেট করে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এর মধ্যে ‘স্পার্টা থ্রি’ নামে একটি জাহাজ রয়েছে। এই জাহাজটির নাম বদল করে পরবর্তীতে ‘উরসা মেজর’ করা হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানান যে ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়ে জাহাজটির উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আছে এবং এই জাহাজ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হলে বাংলাদেশও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারে।
আমেরিকার তরফ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে যে যে জাহাজটিতে করে রাশিয়া মালামাল আনছে সেটি নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। এই জাহাজের প্রকৃত নাম ‘স্পার্টা থ্রি’। এটির নাম বদলে উরসা মেজর করা হয়েছে।
তবে বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রণালয়ের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মেরিন ট্রাফিক এর ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, উরসা মেজর জাহাজটি ১৪ই নভেম্বর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর ছেড়ে আসে।
এই জাহাজটি ২০০৯ সালে নির্মাণ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ১৪২ মিটার এবং প্রস্থ ২৩ মিটার। জাহাজটির সর্বশেষ অবস্থার দেখানো হয়েছে বঙ্গোপসাগরে।
কর্মকর্তারা বলছেন, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য কোন মালামাল আসলে সেটিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরেও রাশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ বাংলাদেশের ভিড়েছে।
তবে সেগুলোতে কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না।