- মইনুল হোসেন ২৪ এপ্রিল ২০২০
করোনাভাইরাস সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের পথ ও পন্থা নির্ধারণের জন্য সরকার ১৭ সদস্যের একটি জাতীয় টেকনিক্যাল উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে। এই উপদেষ্টা কমিটির প্রধান করা হয়েছে নিওন্যাটোলজিস্ট মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। আর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন রোগ ও মহামারী নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করার ব্যাপারে এই জাতীয় কমিটি সরকারকে পরামর্শ দেবে। এই প্রাণঘাতী মহামারী মোকাবেলার জন্য ডাক্তারদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উজ্জীবিতকরণের উপায় সম্পর্কেও তারা সরকারকে সাহায্য করবে।
আমরা এ ধরনের কমিটি গঠন করার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলাম, কারণ আমরা এই প্রাণঘাতী সঙ্কট থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর জরুরি তাগিদ অনুভব করছি। এখন তাদের সুপারিশ যাতে সরকার বাস্তবায়ন করে সেটি এই কমিটিকে নিশ্চিত করতে হবে। এটিকে অসহায়ভাবে বসে থাকার সংস্থা হতে দেয়া যাবে না। করোনা মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতার মুখে প্রদত্ত সুপারিশগুলো কার্যকর করার সক্ষমতা না দেখাতে পারলে কমিটির সদস্যদের পদত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞদের উপদেষ্টা কমিটিকে আমরা জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি হিসেবে দেখতে চাই।
বাংলাদেশে করোনা রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি সঠিকভাবে জানার মতো অবস্থা কতটা ছিল বা আছে সেটিই বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি একবার আমার এক ঢাকাস্থ বন্ধুর বাসায় আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। বন্ধুর বাড়ির সামনে রাখা ছিল একটি সুন্দর রোলস রয়েলস গাড়ি। অত্যন্ত দামি গাড়ি হিসেবে এর সুনাম রয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। স্বাভাবিকভাবেই আমি গাড়িটির প্রশংসা করছিলাম। তখন আমার বন্ধু আমাকে বলল, গাড়িটির ইঞ্জিন নেই। দু’জনেই হাসলাম। বর্তমান ভয়াবহ মহামারীর সময় আমাদের সরকারের কার্যকলাপ দেখলে আমার মনে হয় আমাদের সরকার নামক গাড়িটিরও ইঞ্জিনশক্তি নেই। ফলে প্রশাসনের কোনো দিকই ঠিকমতো চলছে না। জাতি হিসেবে আমরা তো যোগ্যতাশূন্য ছিলাম না যে সরকার চালাতে জানব না।
দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী সরকারিভাবে ধরা পড়ে মার্চ মাসের ৮ তারিখ। যদিও জানুয়ারি মাস থেকেই করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে পৃথিবীব্যাপী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হয়ে যায়। তার পরও বিশেষজ্ঞদের একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে সময় লাগল ৪২ দিন। জনজীবন বিপদমুক্ত রাখতে সরকারের এরূপ নিষ্ক্রিয়তা জাতির মহাসঙ্কটের সময়ও দেখতে হলো। সরকার নিজেই চরম অব্যবস্থাপনার শিকার। সরকারের আশপাশে এত বিবেকহীন ও অযোগ্য চাটুকারদের একত্র করার জন্য সরকারকে কৃতিত্ব দিতে হয়। রাজনৈতিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত লোকদের দিয়ে করোনাভাইরাস ব্যাধির সংক্রমণ থেকে জাতিকে রক্ষার কাজটি মোটেও সহজ হবে না। স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন এতই ভঙ্গুর যে, ডাক্তার এবং নার্সরা নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারেই শঙ্কিত। চিকিৎসার যন্ত্রপাতির অভাবে ডাক্তাররা যদি অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেন তবে রোগীরা বাঁচবে কিভাবে? এজন্যই দেখা যাচ্ছে এ পর্যন্ত ১২০ জনের মৃত্যু হলেও চিকিৎসার মাধ্যমে কেউ সুস্থ হয়েছে তা বলা যাবে না। সবচেয়ে হতাশার ব্যাপার হলো, সরকারের মধ্যে এ ব্যাপারে তেমন ব্যস্ততা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এর আগে সামরিক বাহিনীর লোকদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠিত হলো। এখন নতুন করে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে টেকনিক্যাল উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হলো।
সরকার জানে না যে, লকডাউন বা একতরফাভাবে লোকদের ঘরে আটক রাখা কাজে আসছে না। সরকারের করণীয় বিষয়গুলো সরকারকেও পালন করতে হবে। লকডাউন ঘোষণা করার পর সরকারের দায়িত্ব ঘরে ঘরে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া, কিন্তু সে ব্যাপারে সরকারের কোনো প্ল্যান নেই। অন্য দেশের উদাহরণ থেকেও তাদের শিক্ষা গ্রহণেরও কোনো ইচ্ছা নেই।
লকডাউন বা শাটডাউন পলিসি কার্যকর করতে গিয়ে জনসাধারণ যেসব সমস্যা বা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে তা কিভাবে দূর করা যায় তার সঠিক পথ ও পন্থা খুঁজে বের করার প্রচেষ্টায় ধনী দেশগুলোর প্রত্যেকটি সরকার রাতদিন সর্বক্ষণ কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিন জনগণকে অবহিত করা হচ্ছে কিভাবে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সাংবাদিকদেরও বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে।
আমাদের সরকারের চিন্তাভাবনা হচ্ছে পুলিশি শক্তিই সবকিছু। তাই উপদেষ্টা কমিটিকে প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে লকডাউন ব্যবস্থা কিভাবে জনগণের জন্য সহনীয় করে তোলা যায়। সেইসাথে স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা সঠিকভাবে সজ্জিত করে তোলার জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য যেসব মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি দরকার হবে তা যেমন সংখ্যায় খুব বেশি নয়, তেমনি খুব দামিও নয়। যেভাবেই হোক হাসপাতালগুলো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। অন্যান্য দেশের মতো প্রয়োজনবোধে উড়োজাহাজ দিয়ে এসব যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আনতে হবে। দলীয় রাজনীতির প্রতি অনুগত কিছু স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এখনো অসত্য বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন এবং আড়াল করে যাচ্ছেন সরকারি ব্যর্থতা।
সরকারের ব্যর্থতায় সবাই ক্ষুব্ধ ও হতাশ। করোনা রোধে লকডাউন কিছুতেই সফল হবে না যদি না জনগণকে বাঁচিয়ে রাখার সক্ষমতা সরকার দেখাতে পারে। এ ব্যাপারে আস্থার দারুণ অভাব রয়েছে। যাদের জনপ্রতিনিধি বলা হচ্ছে তারা কি আসলে জনপ্রতিনিধি? তাদের মধ্যেও জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনের তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। এ সরকার নতুন করে আমলাদের দিয়ে রিলিফ বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ‘জনপ্রতিনিধিরা’ কোথায়?
যদিও অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে তবুও আমরা এই প্রত্যাশা পোষণ করতে চাই যে, এই টেকনিক্যাল উপদেষ্টা কমিটি স্থবির হয়ে পড়া স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থাকে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সক্রিয় করে তুলতে সক্ষম হবে। লকডাউন ব্যবস্থা অর্থবহ করে তোলার প্রয়োজনেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যকর হতে হবে। লকডাউন অবস্থার মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা না থাকলে করোনা রোগের বিস্তারই ঘটবে। হাসপাতালে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা একেবারেই নেই। সংবাদে প্রকাশ সাধারণ সর্দি, কাশি নিয়ে কেউ হাসপাতালে গেলেও ডাক্তাররা ভয়ে তাদের চিকিৎসা দিচ্ছেন না। ডাক্তার ও নার্সদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক, মাস্ক ইত্যাদির ব্যবস্থা নেই। এসব বিবেকহীন লোক কোথা থেকে এসেছে সেই প্রশ্নই জনগণকে বিস্মিত করছে।
সরকারের কাছ থেকে আমরা অর্থাভাবের কথা শুনতে চাই না। আমরা দেখেছি সরকার তার পছন্দমতো প্রকল্পগুলোতে কী উদার হস্তে অর্থের অপব্যয় করেছে। প্রায়ই ব্যয়বহুল বিদেশ ভ্রমণেও কত সহজে অর্থ উড়ানো হয়েছে। এমনকি সাধারণ রোগের চিকিৎসা নিতেও সরকারের উচ্চপদস্থ লোকদের নিয়মিত দেশের বাইরে যেতে আমরা দেখেছি। সরকার দাবি করছে যে, তাদের উন্নয়নের জাদুকরি রাজনীতি দেশকে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনীয় ধনী দেশে উন্নীত করেছে।
নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রশ্নে উদাসীনতার জন্য আমাদের জানা মতে এ পর্যন্ত শতাধিক ডাক্তার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ডাক্তারদের একটি সংগঠন, বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের নেতারা বলেছেন, এই সংখ্যা যদি এভাবে বাড়তে থাকে তবে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য কোনো ডাক্তার পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটি দাবি করেছে, ৫৭ জন নার্স সংক্রমণের শিকার হয়েছে এবং অন্য দিকে দেশের আরও ২৭০ নার্সকেও এর সাথে যোগ করতে হবে।
ডাক্তাররা সুনির্দিষ্টভাবে দোষারোপ করেছেন যে, নকল এন-৯৫ মাস্ক এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের কারণে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত প্রথম সারির যোদ্ধারা অধিক হারে সংক্রমিত হয়েছেন। গত বুধবার কুর্মিটোলা হাসপাতালে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার মইন উদ্দিনও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাবে মারা যান। অভিযোগ রয়েছে, তাকে সিলেট থেকে ঢাকায় আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
দেখা যাচ্ছে, সরকারের ভেতরকার চাটুকার-মোসাহেবরা সবার ওপরে টেক্কা দিচ্ছে। সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় এরাই সরকারকে তাদের সুযোগ-সুবিধা হাসিলে কাজে লাগাচ্ছে এবং দুই হাতে চুরি-চামারি দুর্নীতি করে যাচ্ছে। তাদের অভ্যাস জাতির মহাসঙ্কটকালেও বদলাচ্ছে না। হাসপাতালের চিকিৎসাসামগ্রী কিনতে, কম মূল্যে রিলিফের চাল বিতরণে দুর্নীতি চলছে।
সরকারকে বুঝতে হবে, লকডাউন বা শাটডাউন পদ্ধতিই করোনাবিরোধী যুদ্ধের একমাত্র রণকৌশল নয়। উপদেষ্টা কমিটি নিশ্চয়ই সরকারকে সঠিক পরামর্শ দিতে সক্ষম হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি কতটা বাধা হয়ে দেখা দেবে? সরকার তো এখনো জনগণকে দায়ী করে যাচ্ছে। তারা সচেতন নয়। তারা লকডাউন মানছে না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাদের যে বেঁচে থাকতে হবে সে বিষয়টা ভেবে দেখা হচ্ছে না।
করোনা সংক্রমণের ফলে চাকরি হারানোর কারণে যাদের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়েছে তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। অন্যান্য দেশে শুধু চাকরিজীবীদের বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করছে না। ছোট-বড় ব্যবসায়ীদেরও আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে, যাতে তারা ব্যবসার কাজ শুরু করতে পারেন।
আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোকে বলা হচ্ছে স্বল্পসুদে ঋণ দিতে। ব্যাংকে তো টাকা নেই। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেলেও সরকারকে কোনো দুশ্চিন্তায় থাকতে দেখা যায়নি। সরকারের নিজস্ব লোকেরাই লুটপাট করেছেন। তারা আশায় আছেন বিদেশে গিয়ে রাজার হালে জীবন কাটাবেন। এখন লুটেরাদের বলুন, জনগণের লুণ্ঠিত অর্থ ফেরত দিতে।
সবকিছুর পরেও আমরা উপদেষ্টা কমিটির সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করছি। কিন্তু ভরসা পাচ্ছি না। কোনোরূপ চিকিৎসা ছাড়াই অসহায়ভাবে মানুষের মৃত্যুহার বেড়ে চলছে। এ ধরনের অমানবিক পরিস্থিতি আমাদের জাতি হিসেবে ভীষণভাবে ছোট করছে। উপদেষ্টা কমিটির দায়িত্বশীল সদস্যদের তাই সত্য বলার সাহস দেখাতে ব্যর্থ হলে চলবে না। জনগণকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দিতে পারি না। করোনাভাইরাসের মতো দ্রুত সংক্রামক রোগ বিস্তারের ফলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাহায্যের হাত বাড়ানো সহজ হচ্ছে না। সরকারের ওপর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। আস্থার অভাবের কারণে বিদেশী সাহায্য পেতে অসুবিধা হতে পারে। সে জন্যই আমরা চেয়েছি সাহায্য বিতরণের ব্যবস্থা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে কোনো নির্ভরশীল সংস্থার মাধ্যমে কার্যকর করা হোক। জাতীয় পর্যায়ে ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাও সরকার অনুভব করছে না।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট