- জাকির আবু জাফর
- ১৩ মার্চ ২০২২, ২১:৩২
পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের কিছু ব্যক্তিগত চাওয়া থাকে। কিছু পাওয়ার তৃষ্ণা থাকে। কিছু স্বপ্ন থাকে। কিছু ইচ্ছের পতাকা থাকে, যা তাকে দোলায়। আলোড়িত করে। উদ্যম জোগায়। পথ চলতে প্ররোচিত করে। জয় করার প্রেরণা দেয়। বাঁক পেরিয়ে আরো সামনে পথচলার শক্তি আনে।
এভাবেই মানুষ হয় স্বাপ্নিক! হয় আশাবাদী। পথ চলে ভবিষ্যতের দিকে। চলতে চলতে কখনো লোভাতুর হয় মানুষ। লোভের জিহ্বা দীর্ঘ হতে থাকে। হতে হতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তখন মানুষের থেকে বড় হয়ে ওঠে তার লোভ। মানুষের চেয়ে লোভ বড় হলে লোভের কাছে পরাজিত হয় মনুষ্যত্ব। আবার লোভ ছাপিয়ে উঠতে পারলে ওই মানুষই হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠতর।
ব্যক্তিগত চাওয়ার বেশ ক’টি পর্যায় আছে মানুষের জীবনে। একে একটি মইয়ের অনেক ধাপের সাথে তুলনা করা যায়। নিচ থেকে উপরের দিকে এর যাত্রা। কোনো একজন মানুষ এ সবগুলো ধাপ অতিক্রমে সাহসী না-ও হতে পারে। কিংবা তেমন যোগ্য না-ও হতে পারে। প্রথমদিকের ধাপগুলো সব মানুষের আওতায় থাকে। ধাপ যত ঊর্ধ্বের, গুণগত উন্নতিও ততটাই ঊর্ধ্বের। ফলে উপরের ধাপ মানেই নিচের ধাপের চেয়ে কম লোকের অবস্থান। এভাবে সর্বোচ্চ ধাপে মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম।
মানুষের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার প্রথম ধাপ হলো—সুখ। সবাই সুখ চায়। সবাই চায় সুখের হরিণটি তার হয়ে উঠুক। সবার আকাঙ্ক্ষায় উড়তে থাকে সুখপাখি। সুখের আশায় পথযাত্রা শুরু মানুষের। যত পরিশ্রম, যত কষ্ট, সবই এতটুকু সুখের আশায়। সুখ নেই তো কিছু নেই। সুখ নেই তো জীবন মিছে। অথচ জীবনের আটটি পর্যায়ের সুখ মাত্র প্রথমটি। এটি জীবনের একেবারে প্রাথমিক আকাক্সক্ষা। কিন্তু মানুষ সুখের সান্নিধ্য পেতে কী যে মরিয়া! কী যে অস্থির! তবুও সুখ যেন মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকে। সরে সরে থাকে। আকাশের তারার মতো অধরাই থেকে যায় জীবনে।
পৃথিবীতে মানুষের দ্বিতীয় চাহিদা হলো—সম্পদ। মূলত সুখের নেশা থেকেই সম্পদের দিকে মানুষের লোভ লম্বা হয়ে ওঠে। সবার ধারণা, সম্পদই সুখের চাকা কিংবা সুখের আস্ত গাড়ি। সম্পদ হাতে আছে তো সুখের গাড়িও মজুদ। তাই সম্পদ জোগানোর পিপাসা মানুষকে পাগল করে তোলে।
যেকোনোভাবেই সম্পদ জোগানোর মানসিকতা তীব্রতর হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ ন্যায়-অন্যায়ের ধারও ধারে না। অন্যের সম্পদ নিজের করে নিতেও লজ্জা করে না। বরং সম্পদের মালিকানা পেতে নিজের মান-মর্যাদা নিঃশেষ করে দেয়। অপমানের ডোবায় নিজেকে ডুবিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের অনুভূতিও নিভে যায়। শুধু সম্পদ চাই, শুধু সম্পদ। সম্পদের লোভ এমনই ঘোরতর তৃষ্ণা জাগিয়ে দেয় মানুষের বুকের ভেতর যার আগুন নেভানোর পানি থাকে না কোথাও। এ লোভ জ্বলে! এ লোভ জ্বালায়! জ্বলতে থাকে প্রতিক্ষণ!
তৃতীয় চাহিদা হলো—প্রতিষ্ঠা বা সামাজিক স্বীকৃতি। সম্পদ জমাট বাঁধে যার হাতে তার চাই সামাজিক স্বীকৃতি। চাই সামাজিক মর্যাদা। তার ইচ্ছা, সমাজ তাকে স্বীকার করুক। তাকে হিসাবে ধরুক। তাকে গুনতে হবে। সমাজের নানাবিধ কাজে ডাক পড়তে হবে তার। যেকোনো পদক্ষেপে তারও ভ‚মিকা থাকা চাই। সমাজে তারও বিশেষ অবস্থান আছে, অন্যদের এটি ভুললে চলবে না। তার অগোচরে কিছু ঘটবে না। যা ঘটবে তার সাথে যোগ থাকবে তার। তাকে পাশ কাটিয়ে হবে না কিছুই।
চতুর্থ ধাপ হলো—খ্যাতি বা জনপ্রিয়তা। সামাজিক স্বীকৃতিও হলো। লোকেরা গণ্য করল তাকে। এখন তো খ্যাতি চাই তার। অনেক খ্যাতি। তাকে হতে হবে খ্যাতিমান। হতে হবে জনপ্রিয়। এক নামে চিনতে হবে তাকে। আকাশে-বাতাসে উড়বে তার সুনাম। দূরান্তের কানও শুনবে তার কর্ম-কিংবদন্তি। মানুষের মুখে মুখে ফিরবে তার কীর্তিকাহিনী। সবাই বুঝবে তার কদর। পরের নয়, শুধু নিজের গানই শুনবে সে। অন্যদের বাজাতে হবে তার ঢোল। সবাই বাজাবে তার নামের ডুগডুগি। এখানে মানুষ নিজের নামের সাথে এমন কিছু যোগ করতে চায়, যা বেশ আকর্ষণীয়। ফলে মানুষ ছোটে বিভিন্ন পদকের দিকে। পেতে চায় নানাবিধ পুরস্কার। বিশেষণের ওপর বিশেষণ, ডিগ্রির পর ডিগ্রি চায়। পদ-পদবির সমারোহ চায়! এভাবেই খ্যাতির দিকে কাতর হতে থাকে মানুষ।
এ পর্যন্ত ধাপগুলো বেশ সাধারণ। পঞ্চম ধাপ থেকেই মূলত প্রকৃত মানুষের দেখা মিলতে থাকে।
পঞ্চম ধাপ হলো—সম্মান ও মর্যাদা। এ শ্রেণীর মানুষের কাছে সম্পদ এবং খ্যাতি মূল্যহীন। সুখ-দুঃখের খুব বেশি ব্যবধান নেই! সুখ মিললে ভালো। না মিললেও সুখের পক্ষে ঝরান না লালসার জল। এমনকি ক্ষমতাও এদের কাছে নস্যি। বরং ক্ষমতার মসনদ থেকে দূরেই থাকেন এরা। এদের ব্যক্তিত্বের আঁচে গলে যায় লোভ-লালসা। অন্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এরা। নির্মোহ থাকেন সব বিষয়ে। নীরব থাকেন বেশি। প্রয়োজনের বেশি কথা নয়। অপ্রয়োজনীয় কাজ নয়। নয় অকারণ সময় খরচ। কাজের ভেতর আবিষ্কার করেন নিজেকে। নিজের মতো চলেন পথ। পথের শেষে আবিষ্কার করেন আরো নতুন পথ!
ষষ্ঠ ধাপ হলো—উৎকর্ষ সাধন। এরা উন্নত দৃষ্টির মানুষ। জীবনের পক্ষে এদের পদক্ষেপ থাকে বিবেচনা-সিক্ত। সব কিছুতে শিল্পের আনন্দ খোঁজেন এরা। সব কিছুতেই নান্দনিক উচ্চতা খোঁজেন। প্রতিটি বিষয়ে খোঁজেন সৌন্দর্যের চূড়া। এ শ্রেণীর লোক খুবই কম। এরা জগতের কাউকে প্রতিদ্ব›দ্বী ভাবেন না। কারো সাথে তুলনা করেন না নিজের। বরং ফেলে আসা তার গতকালের সাথেই চলে তার তুলনা। কাউকে নয়, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কাজ করেন তিনি। কে তার প্রশংসা করল, কে নিন্দা করল; এতে কিছুই যায় আসে না। এতে তার কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। নিজের কাজে মগ্ন থাকেন তিনি। তার দৃষ্টি থাকে ভবিষ্যতের দিকে। থাকে দূরে। আরো আরো দূরে! পথ তার সম্মুখে। আরো সামনে। প্রশংসায় বেপরোয়া হন না তিনি। নিন্দায় দমেন না একটুও। তার বিবেচনার বিষয় শুধু তার কর্ম। কর্মের অলঙ্কারে সাজিয়ে তোলেন নিজেকে।
সপ্তম ধাপ হলো—প্রভাব। কিছু মানুষ পৃথিবীতে তাদের প্রভাব রেখে যেতে চান। রেখে যান। এ শ্রেণীর লোক আরো কম।
এরা পৃথিবীতে নিজেদের চিহ্ন আঁকেন। এসব চিহ্ন মনে রাখে মানুষ। মানুষের কাছে এরা একধরনের বিস্ময়! বিশেষ ধরনের উপমা। তারা যা করেন তা নিয়ে লেখা হয়। লেখে তার পরবর্তী প্রজন্ম! এরাই পৃথিবীর ইতিহাসখ্যাত মানুষ। এদের কেউ বড় নেতা। কেউ বড় কবি। কেউ খ্যাতিমান শিল্পী। কেউ সমাজ সংস্কারক। কেউ বা বীর। কেউ কেউ বিজ্ঞানী। আবার কেউ মানবহিতৈষী। এরা অন্যকে প্রভাবিত করেন। নিজে প্রভাবিত হন না। অন্যের কর্মে থাকে এদের আদর্শ। এরা কখনো নিজেদের কথা ভাবেন না। মহৎ কাজের জন্য উৎসর্গ করেন নিজেকে। এরা কোনোভাবেই টাকায় বিশ্বাস করেন না। এদের বিশ্বাস কাজে। এরা জানেন, পৃথিবীতে কাজই একমাত্র পরিচয়। কাজের সাফল্যই নির্মাণ করে এদের জীবন-চূড়া।
অষ্টম ধাপ হলো—চূড়ান্ত সত্য। এটিই মানবজীবনে সর্বোচ্চ ধাপ। এ ধাপে মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম। এরা সত্যের সাধক। পৃথিবীতে নবী-রাসূলরা এই শ্রেণীর অন্তর্গত। তাঁরা চূড়ান্ত সত্যের প্রচারক, ধারক ও বাহক। এ শ্রেণীর মানুষ ন্যায়ের খোঁজ করেন। ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। সত্যের পক্ষে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেন। এদের কাছে কোনো ক্ষতিই সত্যের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে না। তারা এমন কিছু করেন যার নমুনা পৃথিবীতে থাকে না। এমন কাজ করেন যার উপমা আগে ছিল না। তাদের সত্যের মানদণ্ড—ন্যায় এবং ইনসাফ। পৃথিবীতে এই দু’টি বিষয় একেবারেই কম। কোথাও কোথাও এবং কখনো কখনো থাকে না একদমই।
সত্যের আঙুল বড় মজবুত। দৃঢ়তায় অটল। স্বচ্ছতায় উজ্জ্বল। যেমন ভেতর। তেমনই বাইরে। সত্যের নকল নেই। ডান কিংবা বাঁয়ে তার একটিই রূপ। তার পথ সরল। আলোর রেখার মতো তির্যক। সত্য মানে সংশয়হীন। দ্বিধামুক্ত। সত্যকে চেনার উপায় বড় সহজ। কারণ সব পরিবেশে তার একটিই রূপ। চেহারা বদলের কোনো বিউটি ক্রিম নেই তার। রূপচর্চার কোনো পার্লারও নেই। ঝকঝকে তকতকে তার মুখ। তাকে সাময়িক আড়াল করা যায়। কিছু সময়ের জন্য গোপন করাও চলে; কিন্তু আড়ালে এবং গোপনেও সে সত্যই থেকে যায়। সময়মতো মেঘের আড়াল থেকে টগবগে সূর্যের মতো জেগে ওঠে সহসা। কেউ স্বীকার করুক বা না-ই করুক এতে তার কিছু আসে যায় না।
জগতের সব মানুষ এক স্বরে যদি কোনো মিথ্যাকে সত্য বলে, মুহূর্তের জন্যও মিথ্যা সত্য হয়ে উঠবে না। আর যদি পৃথিবীর সব মুখ একবাক্যে সত্যকে মিথ্যা বলে, তা-ও সত্য কখনো মিথ্যা হবে না।
আমরা জানি, সত্যকে লুকালেই সে লুকিয়ে যায় না। অস্বীকার করলেও তার বদন এতটুকু মলিন হয় না। কেউ চাপা দিতে চাইলেই চিরকাল চাপা থাকে না সে। বৃক্ষের চারার মতো বাধা ঠেলে উঠে আসে একদিন।
সত্যকে ধারণ করলে, সত্য, সত্য ওঠে একদিন। সত্য আঁকড়ে থাকার শক্তি অপরাজিত। সত্য মানুষকে জীবনের দিকে ডাকে। সুন্দরের দিকে ডাকে। সাফল্যের দিকে ডাকে। সত্য যেমন চূড়ান্ত। সত্যের সাফল্যও চূড়ান্ত।
সত্য ধারণকারীর সামনে সত্য ছাড়া আর কিছুই থাকে না। সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ই হয়। হবেই হবে। সত্যের জন্য সময়ের অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু দরকার পড়ে না। সত্যের চেয়ে সত্য কিছু নেই।