নয়া দিগন্ত অনলাইন
১৪ এপ্রিল ২০২৩
জাপান বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। – ছবি : বিবিসি
বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে নতুন একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে জাপান, যেখানে মূলত নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে রফতানির জন্য পণ্য উৎপাদন করা হবে। এ কারণে গভীর সমুদ্রবন্দর ছাড়াও পণ্য সরবরাহের জন্য সেখানকার সার্বিক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে চায় দেশটি।
গত মাসেই জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার ভারত সফরের সময় বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে এই শিল্পাঞ্চলের প্রস্তাব উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। জাপানি গণমাধ্যমেও এ বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে ত্রিপুরার আগরতলায় ভারত, বাংলাদেশ ও জাপানি কর্মকর্তাদের সভাও হয়েছে এ বিষয়ে। ওই সভার পর ভারতে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোশি সুজুকি রয়টার্সকে বলেছেন, ‘এটা ভারত ও বাংলাদেশের জন্য উইন-উইন পরিকল্পনা হবে’।
অর্থাৎ তার মতে দু’দেশই এ পরিকল্পনা থেকে সমভাবে লাভবান হবে। আগরতলার ওই বৈঠকে জাপানের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের মন্ত্রী জি কিশান রেড্ডি।
আর সভায় যোগ দেয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, এ পরিকল্পনা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর পাশাপাশি জাপান ও অন্য দেশ থেকে বিনিয়োগ আনতে সহায়তা করবে।
এদিকে ভারতে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরপর জাপান বাংলাদেশকে তিনটি প্রকল্পের জন্য ১২৭ কোটি ডলার অর্থায়নের অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরও আছে।
২০২৭ সাল নাগাদ এই সমুদ্রবন্দর চালু হতে পারে। জাপান আশা করছে ওই সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের ঢাকা ও ভারতীয় উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে যুক্ত করে বড় শিল্পাঞ্চলের জন্য ভূমিকা রাখবে।
এটি বাংলাদেশের প্রথম সমুদ্র বন্দর যেখানে বড় আকারের জাহাজ ভিড়তে পারবে এবং এ বন্দর থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। আশা করা হচ্ছে, মাতারবাড়ী বন্দর হওয়ার পর এটি চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাতে সহায়তা করবে।
এখন জাপান চাইছে এই বন্দরের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য সেখানে একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে।
শিল্পাঞ্চলের প্রস্তাব শুধুই বাণিজ্যিক?
জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া এক প্রতিবেদনে বলেছে, নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্র বন্দর হবে জাপানের জন্য একটি কৌশলগত উপাদান, যা কোয়াড পার্টনার দেশ হিসেবে জাপান ও ভারতকে এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব মোকাবেলায় সহায়তা করবে।
কোয়াড একটি জোট যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত আছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনাদিয়ার উত্তরে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ এই লোকেশনটি বন্দর নির্মাণের জন্য চীনের জন্যও আকাঙ্ক্ষিত ছিল, যা কয়েক বছর আগে ঢাকা বাতিল করেছিল।
এ বন্দরটির অর্থায়ন নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরেই কূটনৈতিক লড়াই হয়েছে পর্দার অন্তরালে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মাতারবাড়ি বন্দর ঘিরে বৃহৎ শক্তির খেলায় ভারত জয়ী হয়েছে। একইসাথে জয় হয়েছে ভারতের অংশীদার হিসেবে জাপানের। কারণ শেষ পর্যন্ত চীনের বদলে জাপানের অর্থায়নে হচ্ছে এটি।
তবে এর ভিন্নমতও আছে। অনেকে মনে করেন, বিষয়টি তেমন নয় বরং বাংলাদেশ সরকার চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে। তবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা যেখান থেকে পেয়েছে সেদিকেই অগ্রসর হয়েছে।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, নতুন শিল্পাঞ্চল নিয়ে যে প্রস্তাব এসেছে জাপানের দিক থেকে সেখানে ভূ-রাজনৈতিক বিষয় আছে।
জাপান এখন আঞ্চলিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে খোলস ভেঙে বাইরে এসে একটু একটু করে প্রভাব রাখতে চাইছে। চীন যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে জাপান মনে করছে তাদের খোলসের ভেতরে বসে থাকলে হবে না।
হোসেন বলেন, ‘এ কারণেই বাংলাদেশসহ যেসব দেশের সাথে জাপানের ভালো সম্পর্ক আছে সেখানে আরো বেশি সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে জাপান।’
অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যে বাজার তৈরি করেছে, সেটিও খুব একটা বড় নয় বলেই মনে করেন তিনি। তাছাড়া বাংলাদেশ যেসব পণ্য রফতানি করে পূর্ব ভারতে জাপানিরা সেগুলো নিয়ে কাজ করে না। তারা সাধারণত হাইটেক – মধ্যম পর্যায়ে শিল্প নিয়ে কাজ করে।
হোসেন আরো বলেন, ‘উত্তর পূর্ব ভারতে বরং যতটা সুযোগ ছিল বাংলাদেশ তা নিতে পারেনি নানা বাধার কারণে। এখন জাপান শিল্প প্রতিষ্ঠান করলে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারাও তাতে সামিল হতে পারবে। আর বাংলাদেশী পণ্যের জন্য যত বাধা সীমান্তে আরোপ করা হয় সেটি জাপানের ক্ষেত্রে হবে না।
বিনিয়োগের পেছনে ভূরাজনীতি?
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আজকাল বহুপাক্ষিক বিনিয়োগ প্রস্তাবের মধ্যে ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত বিষয় থাকে।
বাংলাদেশের পাশে বড় দুটি দেশ আছে, যাদের মধ্যে নানা টানাপোড়েন আছে।
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়েই বাংলাদেশকে সংবেদনশীল হতে হবে।’
শিল্পাঞ্চল গড়ার জাপানি প্রস্তাবটি একটি সম্ভাবনাময় প্রকল্প ধারণা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক বিনিয়োগ, ব্যবসায়িক ও যোগাযোগের চিন্তাটা সঠিক।
সীমান্তের লজিস্টিকস এখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের বড় অন্তরায়। নানা ধরনের বাধা আছে। যদিও এ শিল্পাঞ্চল শুধু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য নয়, বরং এর আঞ্চলিক গুরুত্ব আছে বলেই মনে করেন ভট্টাচার্য।
অবশ্য জাপানের প্রস্তাব নিয়ে এতটা চিন্তার কিছু নেই বলে মনে করেন এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, জাপান সাধারণত বিনিয়োগ প্রস্তাবের অন্তরালে রাজনৈতিক খেলা খুব একটা রাখে না।
আহমেদ বলেন, ‘ওরা কমিটেড ইনভেস্টমেন্ট পছন্দ করে। সাধারণত ব্যবসার সাথে কূটকৌশলে তারা যায় না। আবার তারা একচেটিয়া ব্যবসাও করে না। তাই তারা শিল্পাঞ্চল করলে সেটি আদতে বাংলাদেশেরই লাভ হবে। আমরা ব্যবসায়ীরাই উপকৃত হবো।,
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ নামে কয়েকশ কোটি ডলারের চীনা উদ্যোগের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকা জুড়ে অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তুলছে ভারত ও জাপান।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এ মূহুর্তে তিনশরও বেশি জাপানি কোম্পানি কাজ করছে। নতুন শিল্পাঞ্চল নিয়ে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে শিগগিরই অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলতি মাসেই জাপান সফরের কর্মসূচি রয়েছে। সেখানে এসব বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পেতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। যদিও ঢাকায় কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেয়ারব্যাংক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের গবেষণা সহযোগী অনু আনোয়ার নিক্কেই এশিয়াকে বলেছেন, সোনাদিয়ায় বন্দর নির্মাণে চীনের সাথে চুক্তির পরিকল্পনা সফল হয়নি ‘ভারতের বিরোধিতার কারণে’।
আনোয়ার বলেন, কিন্তু চীন যা দিতে পারে সেটি দেয়ার সক্ষমতা ভারতের নেই। সে কারণে জাপানকে স্বাগত জানিয়েছে তারা। ‘এখন এই বন্দরে বাংলাদেশের যেমন লাভ হবে তেমনি ভারতেও কম লাভ হবে না।’
সূত্র : বিবিসি