১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ওই দিন সকালবেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে জড়ো হয়ে ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র) কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করেন। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দফা দিয়ে পরবর্তী সময়ে আন্দোলন হলেও ‘সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ’-এর বিরোধিতাই ছিল সংগ্রামের মুখ্য বিষয়।
উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক বাহিনীর একদল কর্মকর্তার হাতে জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা-সামরিক কর্মকর্তাকে গোপন বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৮২ সালের প্রথম দিক থেকেই মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো একসঙ্গে গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। যখন এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাই করেন, তখন মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দুই দিন পর ২৬ মার্চ সাভার জাতীয় স্মৃতি সৌধে সংগ্রাম পরিষদ সংঘবদ্ধভাবে উপস্থিত হয় এবং সামরিক আইনের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলে। সেনাবাহিনী এসে সমাবেশ ভেঙে দেয়। এ পরিষদই পরবর্তী সময়ে বিস্তৃত হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে রূপ নেয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩। এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের এক গৌরবময় দিন। মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্রবন্দীদের মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্রসমাজ সামরিক আইনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে যাত্রা করে। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রীরা। কার্জন হল ও শিক্ষা ভবনের সামনে শান্তিপূর্ণ মিছিলটি পৌঁছামাত্রই অপেক্ষমাণ পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় শিক্ষার্থীদের ওপর। শহীদ হন জয়নাল, জাফর, দীপালি সাহাসহ নাম না-জানা অনেক ছাত্রছাত্রী। বিকেলে বটতলায় শহীদ জয়নালের জানাজা শুরু হওয়ার মুহূর্তে পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সদস্য পুরো ক্যাম্পাস ঘেরাও করে ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে গ্রেপ্তার করে সেনানিবাস ও বিডিআর সদর দপ্তরের অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয়। পিটিয়ে ট্রাকে তুলতে থাকে শত শত ছাত্রছাত্রীকে।
আমি শহীদ জয়নালের লাশের সঙ্গে মুহসীন হলে আশ্রয় নিই। বটতলা থেকে রেজিস্ট্রার ভবনের দেয়াল টপকে লাশসহ আমরা মুহসীন হলে ঢুকে পড়েছিলাম। পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী জয়নালের লাশ খুঁজে পায় কলাভবনের সমস্ত হল খুঁজতে খুঁজতে। বিকেলে লাশ মুহসীন হলে ঢোকানো হয়েছিল, আর পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী তা খুঁজে পায় মধ্যরাতেরও পরে। কোনো ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী এ তথ্য বাহিনীগুলোকে দেননি। আমি তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (মুনীর-হাসিব) সাংগঠনিক সম্পাদক। সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল থেকে আমি গ্রেপ্তার হই। আমাকে গ্রেপ্তার করার পর আমার ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন খ ম জাহাঙ্গীর, প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম নোমান, আশরাফুল হক মুকুল, লেনিন আজাদ, জালাল আহমেদ, শামসুজ্জামান দুদু প্রমুখ। এমনকি মধুর ক্যানটিনের শহীদ মধুদার ছেলে অরুণকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালায়।
আন্দোলন দমনের জন্য সামরিক জান্তা ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে কারফিউ জারি ও গণগ্রেপ্তার চালালেও ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙে রাজপথে নেমে পড়েন। হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজ হরতাল আহ্বান করে এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ঢাকা মহানগরীতে হাজার হাজার ছাত্র রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, তিতুমীর কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল-হোস্টেল ঘেরাও করে কয়েক হাজার ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে বেইলী রোড, হেয়ার রোডের সামরিক আদালতের প্রাঙ্গণে জমা করে।
গ্রেপ্তারের সময় ও পরে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালান। এদিন শহীদ হন চট্টগ্রামে মোজাম্মেল কাঞ্চন, ঢাকায় জগন্নাথ কলেজের মোজাম্মেল আইউবসহ আরও অনেকে। আমি, খ ম জাহাঙ্গীরসহ যাঁদের সামরিক বাহিনীর বন্দিখানায় এবং সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের ‘সেফ হোল’এ আটকে রাখা হয়েছিল, তাঁদের ওপর চরম নির্যাতন চালানো হয়। জাতীয় নেতৃবৃন্দ ড. কামাল হোসেনের বেইলী রোডের বাসায় ১৫ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে বসে ছাত্র নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেন। সেখান থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ড. কামাল হোসেন, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ তোয়াহা, নির্মল দাস ও অন্যদের গ্রেপ্তার করে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
শিক্ষা ও গণতন্ত্রের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে তুঙ্গ সময় ছিল ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারি। এরপর ১০ দফা রচিত হয়। ১০ দফা কর্মসূচির সঙ্গে ৫, ৭, ৮-দলীয় রাজনৈতিক জোটগুলোর সবাই একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। তিন জোটের রূপরেখাতেও ১০ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিল। তবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রভাব বেশি কাজ করেছে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে, আন্দোলনকে আপসহীন রাখতে এবং শেষ পর্যায়ে ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানকে সংগঠিত করতে।
১৯৮৩ মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলনই পরিণতি লাভ করে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এবং এরশাদের স্বৈরশাহির পতন ঘটে।
- মুশতাক হোসেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু (১৯৮৯-৯০)